অর্থনীতির মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সরে গিয়ে কী সূর্যের দেখা মিলবে?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

অধ্যাপক ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের তিন মাস। এই সময়টাতে সংস্কারের কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে এবং তার কিছু প্রক্রিয়াও সরকার শুরু করেছে। তবে দৃশ্যমান রয়েছে এমন কিছু বিষয় যেগুলো মানুষকে স্বস্তির চাইতে সঙ্কটে রাখছে বেশি। চড়া দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেহাল দশা এবং সর্বোপরি সর্বত্র এক প্রকার অনিশ্চয়তায় মানুষ অনেক বেশি চিন্তিত।

এক কথায় যদি বলি, বেশি ভাবনা অর্থনীতি নিয়েই। বলা যায়, অর্থনীতির স্তিমিত ঝিমুনি ভাব অবরোহণের নিম্নভূমিতে বিচরণ করছে। সেখান থেকে আরোহণের জন্য সরকার কী করছে সেটা স্বচ্ছ নয় মানুষের কাছে। ফ্যাসিবাদ তাড়িয়ে এক সমৃদ্ধ ও শান্তির বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো হয়েছিল, সেই স্বপ্নে ভেসে গিয়ে ওড়ানের পথ চেয়ে দেশের জনগণ সমস্ত কষ্ট ও ভোগান্তিকে সহ্য করে স্বপ্ন দেখতেও শুরু করেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে স্বপ্নের সেই ফানুস চুপসে গিয়ে ভূপাতিত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে অস্থিরতা কমছে না। ঠিক এ লেখা যখন লিখছি তখন খবর এলো যে, টাকা তুলতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে সিলেটের ন্যাশনাল ব্যাংকের শিবগঞ্জ ব্রাঞ্চে গেইটে তালা দিয়েছেন গ্রাহকরা। এ রকম অবস্থা সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক বা গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের কেন্দ্র-প্রান্ত অনেক শাখায়।

অর্থনীতির শম্বুকগতি, শিল্প উৎপাদন তলানিতে, নতুন বিনিয়োগ তো নেই-ই বরং অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী ছাঁটাই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, বাজারে ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদার অভাব, নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য, রপ্তানিতে ভাটা; এগুলোই এখন অর্থনীতির আলোচনায়। অনেকেই হয়তো বলতে চাইবেন গণঅভ্যুথ্যান পরবর্তী সময়ে এমন হয়। কিন্তু তারও তো একটা সময় থাকে। আরও কিছুদিন চললে বলতেই হবে দেশ আসলে মন্দ্রাক্রান্ত অর্থনীতির কবলে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতিকে খাদ থেকে তুলে উত্তরণের পথে দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ কবে সুফল এনে দেবে, তা হয়তো সময়ই বলবে।

খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বলছে, শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে মন্দার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় অর্ধেকে নেমে তিন দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে কৃষি উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে অর্থনীতিকে যত দ্রুত সম্ভব গতিশীল করা। কারণ, অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গেলে সেটা চালু হওয়া বেশ কঠিন। আমরা অর্থনীতিকে স্তব্ধ হতে দিতে চাই না।’ প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কি মানুষের কাছে স্বাভাবিক লাগছে? রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনও স্বস্তি ফেরেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। এ অবস্থায় দিন যতো যাচ্ছে, অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ততোই বাড়ছে।

পোশাক খাতে অস্থিরতায় ১০-১৫ শতাংশ সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে গেছে। কয়েকটি দেশ এই সুযোগ ব্যবহার করে ক্রেতাগোষ্ঠীকে টানার চেষ্টা করছে এবং বেশ খানিকটা সফলও হয়েছে। শিল্পখাতে মূলধন, যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিসহ সব কিছুর আমদানিই কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তার এক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

এই মুহূর্তের প্রধান কাজ হচ্ছে যে করেই হোক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আর এ জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সবই করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কিন্তু কোনো সূচকেই কোনো স্বস্তি নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমছে, বিনিয়োগে বেহাল দশা, রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি, রপ্তানি আয়ে ধীর গতির মধ্যে সরকারকে ভাবতে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা আগেই বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কয়েকদিন আগে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। এডিবি বলেছে, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল বিদায়ী সরকার।

বিনিয়োগে নেই কোনো সুখবর। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রথম প্রান্তিকে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ ব্যয় হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। জুলাই ঘিরে আন্দোলন, অগাস্টের তিন দিন সরকারবিহীন সময়ের নৈরাজ্য এবং এরপর ক্ষমতার পালাবদলের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। উন্নয়ন কাজ কমায় সরকারি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে এজন্য বেসরকারি বিনিয়োগও কমছে। একইভাবে কমছে বিদেশি বিনিয়োগও।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২৯ অক্টোবর বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৪৭ কোটি (১.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল।

আরেকটি বড় ভাবনা রাজস্ব ঘাটতি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, এই তিন মাসে সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর; কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। এনবিআরের হিসাব অনুসারে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ছে, তবে বড় সুখবর দিয়ে যাচ্ছেন প্রবাসীরা। কিন্তু তবুও রিজার্ভ বাড়ছে না। গত ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। এক সপ্তাহ আগে ১৬ অক্টোবর বিপিএম ৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম ৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১৩ কোটি ডলার।

সব হিসেবের বড় হিসেব মূল্যস্ফীতি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এক অঙ্কের ঘরে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে অবস্থান করছে।

স্থির আয়ের মানুষের জীবনমানের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে ঊর্ধ্বমুখী, সে হারে মজুরি বাড়েনি। এর ফলে বাড়তি দামের কারণে মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। একই কারণে সামগ্রিকভাবে চাহিদাও কমেছে। সাম্প্রতিক বন্যা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্যের মতো বিষয় তো রয়েছেই, তবে বেশি সমস্যা হলো জন আস্থা। মানুষ মনেই করছে না যে সরকার জিনিপত্রের দাম কমাতে পারবে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে তিনবার নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

দ্রব্যমূল্য কমছে না কারণ, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা কম। এর ফলে শুধু অর্থনৈতিক নীতিগুলো দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যাপকভাবে কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সেই আশায় আমরা আছি এবং ভাবছি মেঘলা আকাশ কি আরও নিকষ কালো মেঘে ধুম্রাচ্ছন্ন হবে, নাকি মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সূর্যের দেখা মিলবে।

লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সাংবাদিক

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: প্রচ্ছদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × 4 =