২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাঙালির স্বপ্নের নায়িকা সুচিত্রা সেন। ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সুচিত্রা। তখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় তাঁকে। সিনেমাপ্রেমী বাঙালি তো বটেই, বাংলাভাষী প্রত্যেক মানুষই যেন সেদিন শোকাহত হয়েছিল মহানায়িকার প্রয়াণের খবরে।
এখনো যাঁর হাসি ঝড় তোলে লাখো হৃদয়ে, সেই সুচিত্রা সেন মৃত্যুর আগে নিজেকে নিভৃতচারিণী করে রেখেছিলেন প্রায় ৩৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, দেখাটা পর্যন্ত পায়নি বাইরের কেউ। তাঁকে নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ, প্রশংসা—সবই হয়েছে ভূরি ভূরি। তবে তিনি মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছেন চিরন্তন সুন্দরী এক স্বপ্নের মহানায়িকা হয়ে।
মহানায়িকা জানতেন, কখন, কোথায় তাঁকে থামতে হবে, না বলতে হবে। সাফল্যের পেছনে কোনো দিনই ছোটেননি তিনি। বরং পছন্দের ভালো চিত্রনাট্যের খোঁজ করতেন সব সময়। তেমনটা পেলেই সায় দিতেন অভিনয়ে। তাই তো সাফল্য আর জনপ্রিয়তা তাঁর কাছে এসে ধরা দিয়েছে। তিনি কেবল উৎকর্ষতার সন্ধান করেছেন, তারকাখ্যাতি আর সাফল্য তাঁকে খুঁজে নিয়েছিল।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা শহরে জন্ম নেওয়া সুচিত্রা সেনের জন্মনাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। পরিবারের পঞ্চম সন্তান রমা। পাবনার মহাকালী পাঠশালা ও পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর পরিবারের সঙ্গে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে ১৯৪৭ সালে তাঁর বিয়ে হয় বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে। তাঁদের একমাত্র সন্তান অভিনেত্রী মুনমুন সেন।
শোনা যায়, অর্থের প্রয়োজনেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন রমা। তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামী অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে রমাকে চুক্তিবদ্ধ করান সিনেমায়। তাঁর বোন উমাদেবী একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই সিনেমায় নামলি, অভিনয়ের কী জানিস?’ সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘না দিদি, টাকা খুব দরকার, সিনেমা করতেই হবে। চেষ্টা করে দেখি, কতটা পারি।’ রমার চেষ্টা বৃথা যায়নি।
১৯৫২ সালে প্রথম অভিনয় করেন ‘শেষ কোথায়’ সিনেমায়। সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ দিয়ে শুরু হয় তাঁর পর্দাযাত্রা। একই বছর মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়ে সাড়া ফেলে দেন তিনি। সুচিত্রা অভিনীত ৫৩টি বাংলা সিনেমার ২৫টিতেই তাঁর বিপরীতে ছিলেন উত্তমকুমার। সুচিত্রা অভিনীত প্রথম হিন্দি সিনেমা ‘দেবদাস’ (১৯৫৫)। ক্যারিয়ার শুরুর ১০ বছরের মাথায় আসে জীবনের অন্যতম সেরা স্বীকৃতি। ‘সপ্তপদী’র জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান সুচিত্রা। সুচিত্রা সেনই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি এই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
বরাবরই জেদি, দৃঢ়চেতা স্বভাবের অধিকারিণী ছিলেন সুচিত্রা সেন। ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে জ্বলজ্বলে, তখনই নিজেকে আড়াল করে নেন সুচিত্রা। সালটা ছিল ১৯৭৮। শেষ সিনেমা ছিল ‘প্রণয় পাশা’। এর পর থেকে তিনি ছিলেন অন্তরালে। মাঝে একবার তাঁকে দেখা গিয়েছিল ভোটের জন্য ছবি তুলতে, আরেকবার মহানায়ক উত্তমকুমারের প্রয়াণের দিনে। রজনীগন্ধা হাতে মহানায়কের নিথর দেহের দিকে চেয়ে সুচিত্রা সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি হেরে গেলাম উত্তম।’ সুচিত্রা অভিনয় ছাড়ার কথা প্রথমে জানিয়েছিলেন তাঁর মেকআপ আর্টিস্ট মহম্মদ হাসান জামানকে।
২০১৪ সালে সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর পর ১৬ জুলাই তাঁর পাবনার আদি বাড়িতে সংগ্রহশালা নির্মাণের আদেশ দেন বাংলাদেশের আদালত। এরপর সেখানে তৈরি হয় সংগ্রহশালা। এখনো বাঙালির জীবনের সঙ্গে নানাভাবেই জড়িয়ে আছেন সুচিত্রা সেন। তাঁর স্টাইল, ফ্যাশন সেন্স এবং গ্ল্যামার নিয়ে আজও সমানভাবে চর্চা হয়। এ সময়ের নায়িকারাও অনুসরণ করেন তাঁকে।