রোজ অ্যাডেনিয়াম
লোকটা এখন বুড়ো বলে কেউ করে না ভক্তি,/ যৌবন কালে শরীরে তার ছিলো প্রচুর শক্তি।/ লোকটার এখন দাড়ি পাকা মাথায় ভরা টাক,/ অচল হয়ে পড়ে আছে সবাই বলে থাক।/ লোকটা কেঁদে কেঁদে বলে বাঁচি কেমন করে,/ সবাই বলে বুড়ো মানুষ যাচ্ছে না ক্যান মরে।/ ক’দিন আগেই বলতো লোকে সমাজ তোকেই চায়,/ অথচ আজ এই লোকটার বেঁচে থাকাই দায়।/ লোকটা এখন বিছনাগত দুর্দশাতে আজ।/ অসময়ে বদলে গেছে সবার কথার ভাঁজ।
অধিকাংশ প্রবীণ মানুষদের শেষ জীবনের চিত্র এমনই। সারাজীবন যাদের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন প্রবীণরা, শেষ জীবনে তাদের কাছে একটুখানি ভালোবাসায় চান তারা। কিন্তু বাস্তবতা হয় ভিন্ন। অনেক সময় আদরের সেই সন্তানেরা বাবা-মাকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেন, কষ্ঠ দেন। অথচ ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, এই বাসনা নিয়ে মা-বাবা তাদের সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন, নিরাপত্তা দেন, তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চান। তারা স্বপ্ন দেখেন, সন্তান একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সম্প্রতি প্রকাশিত খবর, বাবা-মা দাবি পূরণ করতে না পারায় সন্তান আত্মহত্যা করেছে। এমনকি বাবা-মাকে হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। নবীনরা যদি অনুধাবন করতো আগামী দিনে সেও প্রবীণ হবে। তাহলে সুন্দর হতো প্রবীণদের পৃথিবী। প্রতিবছর জুন মাসে বিশ্বজুড়ে প্রবীণদের কথা মাথায় রেখে পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস’।
বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস
প্রতি বছর ১৫ জুন বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস পালিত হয়। এই দিবস পালনের লক্ষ্য, বয়স্কদের উপর নির্যাতন এবং তাদের যন্ত্রণা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। উন্নয়নশীল এবং উন্নত সব দেশেই প্রবীণদের নির্যাতন কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে প্রবীণ নির্যাতনের বিষয়গুলো খুব কম সামনে আসে। প্রবীণদের উপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন হয়। সেটা হতে পারে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক অথবা অর্থনৈতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ৬ জন বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অর্থাৎ প্রায় ১৪১ মিলিয়ন প্রবীণ সারা বিশ্বে নির্যাতনের শিকার। এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কারণ বেশির ভাগ প্রবীণ নির্যাতন নথিভুক্ত হয় না।
২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথম প্রবীণ নির্যাতন বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তীতে এটিকে বৈশ্বিক সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর প্রিভেনশন অব এল্ডার অ্যাবিউজ (আইএনপিইএ) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৫ জুন বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানায়। এরপর ২০১১ সালে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
কেন অজানা এই দিবসটির কথা
দুঃখের বিষয় হলো দিবসটিকে সব দেশে এখনো সমান গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশে এখনো সরকারিভাবে দিবসটির কোনো স্বীকৃতি নেই, তাই পালনও করা হয় না। ফলে অধিকাংশ নাগরিকের কাছে প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসের তাৎপর্য অনেকটাই অজানা।
যে ধরনের সংকটে প্রবীণরা
এক সময় প্রবীণবান্ধব সমাজ ছিল, শ্রদ্ধা করা হতো তাদের। ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না তাদের জন্য। কিন্তু দিনে দিনে মানবিকতার অধপতন হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা কমছে ক্রমশ। বড় পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাদের বড় হওয়ার পেছনে যে মানুষগুলোর অবদান তা মনে রাখছে না। প্রবীণদের প্রতি নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে, সন্তান এবং আত্মীয়দের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আহত নিহতের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। বাসা থেকে বের করে দেওয়া, আঘাত করা, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া, গালমন্দ করা, খেতে না দেওয়া, নিজেরা ভালো খাবার খেয়ে তাদের ভালো খাবার না দেওয়াসহ নানা ধরনের নির্যাতন হচ্ছে বাংলাদেশে। এছাড়াও আমাদের প্রবীণরা অর্থনৈতিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। তাদের জমানো টাকা-সম্পদ ছেলে-মেয়েরা নিয়ে যাচ্ছে। একসময় তাদের খোঁজও না। ফলে প্রবীণরা অসহায় এবং মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রবীণ স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। স্বামীকে এক জায়গায় স্ত্রীকে আরেক জায়গায় রাখা হচ্ছে, যা তাদের মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। প্রবীণ বয়সে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকে, তাই তাদের আলাদা রাখাও একটা নির্যাতন। প্রতিনিয়ত প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে নির্যাতনও বাড়ছে। এক জরিপ বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৫ ভাগের ১ ভাগ থাকবে প্রবীণ। তাই সববয়সী মানুষদের সচেতন করা না গেলে প্রবীণ নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সচেতনতা প্রবীণদের সুদিন ফেরাবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার, সংখ্যায় ১৪ কোটিরও বেশি। তবে প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়েও বেশি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সব সমাজেই প্রবীণ নির্যাতনের বিষয়টি আড়াল করার প্রবণতা রয়েছে। এটি নিয়ে রাখঢাক, লুকোচুরি, নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্রই বিরাজমান; এমনকি পরিবারে সর্বাধিক গোপনীয় বিষয়ই হচ্ছে এটি। তাই প্রবীণ নির্যাতন সম্পর্কে প্রকৃত সত্য কোনো সমাজেই জানা যায় না; জানানোও হয় না। প্রবীণদেও সুদিন ফেরাতে নবীন-প্রবীণ সবাইকে সচেতন হতে হবে। যারা প্রবীণ আছেন তাদেরও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রতিটি প্রবীণের প্রতি সন্তানের দেখাশোনা ভরণ-পোষণ সহানুভূতি নয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে। নবীনদেরও ভাবতে হবে আগামীকাল তাকেও প্রবীণ হতে হবে। নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে প্রবীণ নির্যাতন বন্ধ করে তাদের ভালোবাসতে হবে।
যেভাবে বন্ধ হতে পারে প্রবীণ নির্যাতন
ফোরাম ফর দ্য রাইটস অব এল্ডারলি, বাংলাদেশ এর সহসভাপতি ড. শরীফা বেগম লিখেছেন, ‘প্রবীণ নির্যাতনকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভাবা, এ বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির করা এবং এর প্রতিরোধ-প্রতিকারের বিষয়ে চেষ্টা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন জরুরি। সরকার ও সমাজ সবাইকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে এবং আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনে সরকারকে কঠোর নীতি গ্রহণ এবং আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। এ প্রসঙ্গে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ’ আইনটির কথা উল্লেখ যায়। আইনটি ২০১৩ সালে পাস হলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো দৃশ্যমান প্রয়োগ দেখা যায়নি, এর জন্য প্রায়ই সন্তানের প্রতি মা-বাবার আবেগকে দায়ী করা হয়; কিন্তু এর একটি বাস্তব দিকও আছে। রাষ্ট্রের তরফে প্রবীণদের জন্য এখন পর্যন্ত বয়স্ক ভাতা ছাড়া তেমন কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা নেই, যার আওতায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশের মতো প্রবীণ মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে থাকেন, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এ রকম বাস্তবতায় সন্তানের আশ্রয়ে থেকে সন্তানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ বা তাদের সঙ্গে বিরোধে যাওয়া মা-বাবার জন্য কতটা বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিগ্রাহ্য, সেটি ভাবার বিষয়। প্রবীণদের জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত বা কার্যকর করতে চাইলে তাই তাদের জন্য বিকল্প সুরক্ষাব্যবস্থা যেমন, শেল্টার হোম বা আশ্রয়কেন্দ্র, প্রবীণ নিবাস বা এ জাতীয় ব্যবস্থা (যা কমিউনিটিভিত্তিক হলে ভালো হয়) গড়ে তুলতে হবে, যার সুরক্ষা নিয়ে প্রবীণরা প্রয়োজনে তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচারের আইনি প্রতিকারের চাইতে পারেন। প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সুরক্ষাই একমাত্র পথ নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় পর্যায়ে প্রবীণদের জন্য ‘প্রবীণ কমিটি’ করা যেতে পারে, যেটি এলাকার প্রবীণদের দৈনন্দিন ভালো-মন্দ দেখভাল করবেন এবং স্থানীয়ভাবে পারিবারিক, সামাজিক সমস্যার সমাধান দেবেন। এনজিওর অভিজ্ঞতা বলে, স্থানীয় পর্যায়ে প্রবীণদের সংগঠিত করেও প্রবীণবিষয়ক অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমাজে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চাও বাড়াতে হবে; মানবিক আচরণকে পুরস্কৃত করে উৎসাহিতও করা যেতে পারে। মোটকথা, প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।’
শেষ কথা
পাকা চুলের মানুষ দেখলে ভেতর থেকেই সম্মান এসে যাওয়ার কথা। একসময় তরুণরা অপেক্ষা করতো কবে তার চুল পাকবে। সে সবার সম্মানের পাত্র হবে। আবার নবীনদের দেখে প্রবীণরাও ফিরে যেতে চায় তার দুরন্তপনার দিনগুলোতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘প্রবীণ ও নবীন’ শিরোনামের কবিতায় বলেছেন ‘পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়,/ কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে হায়-হায়।/ পাকা চুল বলে, মান সব লও বাছা,/ আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।’ প্রবীণদের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি ও নবীনদের শক্তি এক হলে পৃথিবীটা শান্তিতে ভরে উঠবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস