নূর জাহান
২৫ মে মুক্তির পর বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স ও যমুনা ব্লকবাস্টারে সিনেমাটি এক সপ্তাহ চলেছে। তারপর সপ্তাহেও নারায়নগঞ্জের সিনেস্কোপে চলেছে। ‘আদিম’ একবাক্যে চমৎকার এক সিনেমা। নির্মাতা যুবরাজ শামীমের শৈশব-কৈশোর কেটেছে গাজীপুরের টঙ্গীতে। নিজের প্রথম সিনেমার গল্পও বেছে নিয়েছেন এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের কাছ থেকে। টঙ্গীর এক বস্তিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প। ‘আদিম’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন বস্তির মানুষেরাই। অভিনয়শিল্পীদের মাঝে পরিচিত শিল্পীর দেখা মিলবে না।
সিনেমাজুড়ে নির্মাতা নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন তা প্রতিটি ফ্রেমে ধরা দিয়েছে। মোটা দাগে বলতে হয়, শামীমের সৎ উদ্দেশ্যের সিনেমা ‘আদিম’। ক্যামেরার পিছন থেকে মনের মধ্যে যে গল্পটা পুষে রেখেছিলেন সেটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। হয়তো তিনি খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সিনেমাটা দেশের হলে মুক্তি পেয়েছে বলে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আদিমের মতো সিনেমা কালেভদ্রে এক-দুইটা হয়। ‘আদিম’ সহজ কথায় একটা ডিরেক্টর’স সিনেমা। পরিচালক নিজের গল্পটা বলেছেন নিজের মতো করে।
‘আদিম’ সিনেমা এগিয়ে চলে টঙ্গী রেলস্টেশন সংলগ্ন নিম্নশ্রেণির মানুষের গল্প নিয়ে। তাদের রোজকার ঘটনাগুলো বড় ক্যানভাসে দেখিয়েছেন যুবরাজ শামীম। সিনেমাজুড়ে বস্তির মানুষের গল্পগুলো একটা বাস্তব আবহ তৈরি করেছে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য; মানুষের রিপুর প্রতিটা উপাদান যে বস্তিতে বিদ্যমান। গল্পের একেক সময় একেকটা চরিত্রের মাঝে তা ফুটে ওঠে। অনিয়ম মাফিক সকাল-সন্ধ্যা বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে চরিত্রগুলোর মাঝে।
সিনেমার মুখ্য চরিত্র ‘ল্যাংড়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাদশা। বাকি চরিত্রগুলো সোহাগী খাতুন, দুলাল মিয়া, সাদেকসহ সবাইকে নেওয়া হয়েছে বস্তি থেকেই। বস্তির বাসিন্দাদের কাছ থেকে অভিনয়টা যেভাবে বের করে আনলেন নির্মাতা যুবরাজ শামীম সেজন্য একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য। অপেশাদার প্রতিটি শিল্পী যেভাবে চোখে চোখ রেখে ফাস্ট টু লাস্ট অভিনয় করলেন এককথায় তাদের পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ না হওয়ার সুযোগ নেই। নিঃসন্দেহে ‘আদিম’ সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে বস্তিবাসীদের জীবনের দৈনন্দিন গল্পগুলো তুলে ধরার প্রচেষ্টা। বস্তির বাসিন্দাদের একেকটা ঘর একেকটা আলাদা গল্প বলে।
এক দম্পতির গল্পের মধ্য দিয়ে সিনেমা এগিয়ে চলে। সিনেমায় কালা আর সোহাগী; তারা স্বামী-স্ত্রী। সোহাগীর ছোট্ট সংসারে শান্তি নেই, স্বামীর মাদকাসক্তির জন্য। মাদকাসক্ত ‘কালা’ একপর্যায়ে পরিবার ত্যাগ করে ঢুকে পড়েন অপরাধ জগতে। নানান অপরাধ সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে ‘কালা’র জীবন। সোহাগী একাই পরিবারটা টেনে নিয়ে যান। বারবার লাঞ্চিত হতে হয় এই নারীকে। কালা-সোহাগী দম্পতির জীবনে আচমকা আবির্ভাব ঘটে ‘ল্যাংড়া’ নামের চরিত্রের। ভাই হিসেবে ঠাঁই পায় এই ব্যক্তি। তার কাছ থেকে খাবারের বিনিময়ে মাসে ভালো টাকা পাওয়া যায়। ‘কালা’ বেশ সুখেই জীবন কাটাচ্ছিল। কিন্তু ‘ল্যাংড়া’র মাঝে আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠে। তিনি পরকীয়ার দিকে ধাবিত হয়ে যান। সিনেমায় মানুষের রিপুর খেলা এখানেই বিরাজমান। আদিম রিপুর খেলা আর সেই খেলার সর্বশেষ পরিণাম হয় ভীষণ ভয়াবহ।
সিনেমার শুরুর দিকে কুড়ি মিনিট ধৈর্য ধরার প্রয়োজন হবে; গল্পের মোড় কোথায় যাচ্ছে তা দেখার জন্য। মোটাদাগে বলতে পারি ‘আদিম’ বস্তিবাসীদের অপরাধ চক্র বা মাদকের আখড়ার টিপিক্যাল কোনো গল্প না। গল্পের আলাদা একটা নিজস্বতা রয়েছে। যা সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত দেখতে বাধ্য করবে। সিনেমাজুড়ে মিথ্যা, মাদক, চুরি, ছিনতাই, গালিগালাজ, সন্দেহ, লোভ, লালসা, কামনা, ছলনা, পারিবারিক ভায়োলেন্স, নিজের অক্ষমতা প্রকাশের অনীহা, পরকীয়া, খানিকটা সুখের সন্ধানে অপরিচিত একজন মানুষের সাথে পালিয়ে যাওয়া, নিজের স্বার্থ হাসিল; এমন খুব কম আদিম প্রবৃত্তিই আছে যা এই সিনেমায় উঠে আসেনি।
‘আদিম’ সিনেমায় আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রাখা হয়নি। সিনেমার মিউজিক নিয়ে বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। সিনেমার কালার গ্রেডিং খুবই সুন্দর লেগেছে বড় পর্দায়। সিনেমাটোগ্রাফি ছিল সিনেমার গল্পের সঙ্গে মানানসই। চিত্রগ্রাহক আমীর হামজার হ্যান্ডহেল্ড শট বেশিরভাগ সিকুয়েন্সকে করেছে অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক। সিনেমার প্রোডাকশন ডিজাইন খুবই চমৎকার হয়েছে। তা আসলে বস্তিতে শুট করার কারণেই সম্ভব হয়েছে। সিনেমায় আলাদা করে সংগীত যুক্ত করা হয়নি। বস্তিবাসীরা নিজেদের জীবনের যাবতীয় অনুভূতি খালি গলায় গাওয়া গান গেয়েই প্রকাশ করে। ‘আদিম’ সিনেমাতেও তেমনটা রাখা হয়েছে। অবশ্য সিনেমায় লিরিক্স রাইটার হিসেবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নাম দেখা যায়।
‘আদিম’ সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিভিন্ন মেটাফোর ব্যবহার করা। স্টেশনে আসা ট্রেন আর স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন দিয়ে জীবনের বহমানতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন নির্মাতা। ‘আদিম’ যে শুধুমাত্র এই বস্তিবাসীদের গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নয়। যুবরাজ শামীম হয়তো তাদেরকে সকলের মাঝে উপস্থাপন করে মূল মেসেজটা সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষকে দিতে চেয়েছেন। সমাজে সব শ্রেণির মানুষ আদিম প্রবৃত্তির মধ্যে আটকে আছে! সিনেমার উল্লেখযোগ্য খারাপ দিক নেই বললেই চলে। যেহেতু কোনো পেশাদার অভিনয়শিল্পী ছিল না, সেহেতু অভিনয়ে কিছু ছোটখাটো ভুল হয়েছে। তা বিশেষভাবে উল্লেখ্য না। ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের সিনেমার দুর্দান্ত এডিটিং সিনেমা শেষে তৃপ্তির দেবে।
‘আদিম’ সিনেমায় প্রান্তিক মানুষের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে। যুবরাজ শামীম নির্মাতা চেয়েছিলেন তাদের দিয়েই অভিনয় করাতে। চরিত্র খোঁজার জন্য, তাদের জীবন গভীরভাবে বোঝার জন্য টঙ্গীর বস্তিতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন নির্মাতা। নিজের প্রথম সিনেমার চরিত্র খোঁজার জন্য ৭ মাস টঙ্গীর বস্তিতে থেকেছেন এই তরুণ। কল্পনা করা যায় সিনেমার প্রতি তার ডেডিকেশন কতো। তার চেষ্টা বৃথা যায়নি। সিনেমার প্রধান চরিত্র বাদশাকে প্রথম পাওয়া যায় কিন্তু রেলস্টেশনে। কেউ তখন তাকে মাদক ব্যবসায়ী বলেছেন, আবার কেউ বলেছেন মতলববাজ। পুলিশি হয়রানির শিকারও হয়েছেন নির্মাতা যুবরাজ শামীম কয়েকবার।
৪৪তম মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড জেতার পর যুবরাজ শামীমের ‘আদিম’ সিনেমা নিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আলোচনা শুরু হয়। এরপর ধাপেধাপে যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, ইতালিসহ অনান্য দেশের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে সিনেমাটি যখন পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয় তখন সবাই নড়েচড়ে বসে সিনেমাটি দেখার জন্য।
সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেছেন ‘হাওয়া’ সিনেমা খ্যাত নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন। সিনেমার ট্রেলারটি নির্মাণ হয়েছে তার তত্ত্বাবধানে, সজল অলক বানিয়েছেন। মূলত সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তির আগে নতুন করে সকলের নজর কাড়ে ট্রেলার রিলিজ হওয়ায় পরেই।
‘আদিম’ নির্মিত হয়েছে গণমানুষের অর্থায়নে। টাকার জন্য অনেকবার থেমে গিয়েছে নির্মাতা যুবরাজ শামীমের সিনেমা বানানোর স্বপ্ন। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে নেদারল্যান্ডসের নির্মাতা ক্রিমেনটিনে এডারভিকনকে শামীম সিনেমার গল্প ও নির্মাণ পরিকল্পনা শোনা। তিনি তখন ২০০ ইউরো দিয়ে যান যুবরাজ শামীমকে। সেটা দিয়ে শুরু হয় প্রথম সিনেমা বানানোর কাজ। পরে সিনেমার শেয়ার বিক্রি শুরু করেন তিনি। কেউ শেয়ার কিনলেই সেই টাকা দিয়ে শুটিং করতেন। নির্মাতাদের মধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ছবির শেয়ার কিনেছিলেন। এই তরুণ পরিচালককে ৫৩ জন শেয়ার কিনে সিনেমা নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। পাঁচ বছরের চেষ্টায় নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ সিনেমাটি।
আদিম সিনেমা নির্মাণে ক্যামেরায় ছিলেন আমির হামজা, সহকারী পরিচালক আনন্দ সরকার আর পরিচালক যুবরাজ নিজে। মাত্র এই তিনজনের টিম নিয়ে হয়েছিল পুরো ছবির শুটিং। নির্মাতা যুবরাজ শামীমের ছিল সিনেমার প্রতি ভালোবাসা, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও নিজের লক্ষ্যে লেগে থাকার প্রবণতা। সৎ উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করার চেষ্টা করলে এগিয়ে আসেন গুণী মানুষেরা তাও দেখা যায় যুবরাজ শামীমের নির্মাণ জার্নিতে। এই যেমন তার সাথে যুক্ত ছিলেন হাওয়া খ্যাত নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন। শেয়ার কিনে যুক্ত হয়েছেন মেধাবী নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। নিশ্চয়ই তারা বুঝেছিলেন, এই তরুণের সিনেমার প্রতি ডেডিকেশন। চেষ্টা করলে সফলতাও ধরা দেয় তাও দেখা যায় যুবরাজ শামীমের সিনেমা তৈরির জার্নিতে। মস্কো জয় করেছেন তো এমনি এমনি না। যুবরাজ শামীমের আদিম কিভাবে তৈরি হলো এটা নিয়ে আস্ত একটা সিনেমা নির্মাণ করে ফেলা সম্ভব।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি