আধিপত্তের ধারাবাহিকতা ও বাংলাদেশের সংগ্রাম

ভূমিকা

মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত ক্ষমতা, আধিপত্ত, প্রতিরোধ ও মুক্তির ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাস। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে দেখা যায়—শক্তিশালী রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই নিয়ন্ত্রণ কখনো সরাসরি শাসনের মাধ্যমে, কখনো অর্থনৈতিক নির্ভরতা সৃষ্টি করে, আবার কখনো ভাষা, সংস্কৃতি ও চিন্তাচেতনার ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। আধুনিক রাজনৈতিক পরিভাষায় এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াই আধিপত্ত (Hegemony) নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের ইতিহাস আধিপত্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী উদাহরণ। পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক দমন ছিল আধিপত্তের এক নির্মম ও ঔপনিবেশিক রূপ, যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে জন্ম নেয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার মাধ্যমে সেই প্রত্যক্ষ আধিপত্তের অবসান ঘটলেও বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি আধিপত্তের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব আজও বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও জাতীয় স্বার্থকে প্রভাবিত করে চলেছে।

১. আধিপত্তের সংজ্ঞা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আধিপত্ত বলতে এমন এক ক্ষমতাগত সম্পর্ককে বোঝায়, যেখানে একটি রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী অন্য কোনো রাষ্ট্র বা সমাজের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই প্রভাবকে স্বাভাবিক বা বৈধ হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

ইতালীয় মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি আধিপত্তের ধারণাকে নতুন মাত্রা দেন। তাঁর মতে, শাসকগোষ্ঠী কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, গণমাধ্যম ও সামাজিক মূল্যবোধের মাধ্যমে শাসিত জনগোষ্ঠীর সম্মতি অর্জন করে। এই সম্মতির ভিত্তিতেই আধিপত্ত দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর হয়।

আধুনিক বিশ্বে আধিপত্তকে সাধারণত তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়—

১) প্রত্যক্ষ আধিপত্ত: সামরিক দখল বা সরাসরি শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ

২) পরোক্ষ আধিপত্ত: অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ

৩) সাংস্কৃতিক আধিপত্ত: চিন্তা, মূল্যবোধ ও পরিচয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার

২. আধিপত্তের প্রকারভেদ

২.১ রাজনৈতিক আধিপত্ত

রাজনৈতিক আধিপত্ত তখনই সৃষ্টি হয়, যখন কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সরকার গঠন, নির্বাচন, সংবিধান প্রণয়ন কিংবা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়।

২.২ অর্থনৈতিক আধিপত্ত

অর্থনৈতিক আধিপত্তের ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্র ঋণ, বাণিজ্যচুক্তি, বিনিয়োগ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে নির্ভরশীল করে তোলে। একপর্যায়ে এই নির্ভরশীলতা জাতীয় অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

২.৩ সামরিক আধিপত্ত

সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, অস্ত্র সরবরাহে নির্ভরতা কিংবা নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে সামরিক আধিপত্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণের সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।

২.৪ সাংস্কৃতিক আধিপত্ত

ভাষা, চলচ্চিত্র, সংগীত, শিক্ষা ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে একটি জাতির চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে প্রভাব বিস্তার করাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্ত বলা হয়। এটি আধিপত্তের সবচেয়ে সূক্ষ্ম, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ হয়ে দাড়ায়।

২.৫ কূটনৈতিক আধিপত্ত

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আঞ্চলিক জোটে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অবস্থান বা সিদ্ধান্তকে নিজের স্বার্থে প্রভাবিত করে। এই ধরনের আধিপত্ত প্রায়শই পরোক্ষ হলেও কার্যকর প্রভাব ফেলে।

৩. পাকিস্তানি আধিপত্ত (১৯৪৭–১৯৭১)

৩.১ রাষ্ট্রগঠনের প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট ছিল। বিপুল ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্রের কাঠামোয় আবদ্ধ থাকার ফলে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হয়।

৩.২ রাজনৈতিক আধিপত্ত ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

রাষ্ট্রক্ষমতা, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত।

৩.৩ ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্ত

উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত ছিল সাংস্কৃতিক আধিপত্তের একটি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। এর বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এই আধিপত্তের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ও মৌলিক প্রতিবাদ।

৩.৪ অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য

পূর্ব পাকিস্তানের পাট, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় অংশ এবং রাজস্ব পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়ন ও উন্নয়নে ব্যবহৃত হতো। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুই অংশের মধ্যে চরম বৈষম্য বিরাজ করছিল।

৩.৫ সামরিক শাসন ও দমননীতি

বারবার সামরিক শাসন জারি করে গণতান্ত্রিক অধিকার স্থগিত ও দমন করা হয়। ১৯৭১ সালে পরিচালিত সামরিক অভিযান ছিল এই আধিপত্তের চূড়ান্ত ও নৃশংস প্রকাশ।

৩.৬ গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধন

পাকিস্তানি বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যা এবং পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।

৩.৭ পরিণতি ও ঐতিহাসিক শিক্ষা

এই দীর্ঘস্থায়ী ও কাঠামোগত আধিপত্তের পরিণতি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ইতিহাস প্রমাণ করে, ধারাবাহিক শোষণ ও বৈষম্য শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ, সংগ্রাম এবং বিচ্ছিন্নতার পথই তৈরি করে।

৪. ভারতের প্রভাবভিত্তিক আধিপত্ত

ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর সরাসরি শাসন বা দখলের কোনো ঐতিহাসিক নজির নেই। তবে স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশে নিয়মিত আলোচনা ও বিতর্ক হয়ে আসছে। এই প্রভাবকে অনেক বিশ্লেষক প্রভাবভিত্তিক আধিপত্ত (Influence-based Hegemony) হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

৪.১ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য বাস্তব ও কৌশলগত প্রয়োজন হলেও, অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা জাতীয় স্বার্থের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে—এমন মতও বিদ্যমান।

৪.২ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব

বাংলাদেশ–ভারত বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা দীর্ঘদিনের আলোচ্য বিষয়। আমদানি–রপ্তানির পার্থক্য, ট্রানজিট সুবিধা এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশে সমালোচনা রয়েছে যে, সব সিদ্ধান্ত সবসময় পারস্পরিক সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে গৃহীত হয়নি।

৪.৩ পানি বণ্টন ও পরিবেশগত প্রভাব

অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন—বিশেষ করে তিস্তা ও গঙ্গা—বাংলাদেশের জন্য একটি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ কৃষি, পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, যা আধিপত্ত সংক্রান্ত আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পায়।

৪.৪ সীমান্ত ও মানবাধিকার ইস্যু

বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে প্রাণহানি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দুই দেশের সম্পর্কে বারবার উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনাও প্রভাবভিত্তিক আধিপত্তের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

৪.৫ সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া প্রভাব

ভারতীয় চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও ডিজিটাল কনটেন্ট বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। একদিকে এটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও, অন্যদিকে স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল শিল্পের ওপর এর প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

৫. আধিপত্তের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি

আধিপত্ত কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক সংহতি এবং ভবিষ্যৎ বিকাশকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদে আধিপত্ত আত্মনির্ভরশীল নেতৃত্ব ও স্বাধীন চিন্তার সক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।

আধিপত্তের প্রধান ক্ষয়ক্ষতিগুলোর মধ্যে রয়েছে—

রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা

অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ও সম্পদের অপসারণ

সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস ও স্বাতন্ত্র্যের অবক্ষয়

নাগরিকদের মধ্যে আত্মসম্মানহীনতা, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা

৬. আধিপত্ত থেকে মুক্তির কৌশল

আধিপত্ত থেকে মুক্তি কোনো এককালীন ঘটনা নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। রাষ্ট্রীয় কাঠামো, অর্থনীতি, সমাজ এবং নাগরিক মানসিকতা—সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ এর প্রয়োজন।

৬.১ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তির কৌশল

প্রথমত, একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। কোনো একটি শক্তিশালী দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আধিপত্তকে সহজ করে তোলে। বহুমুখী কূটনীতি এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন জোটের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা সুরক্ষায় সহায়ক।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আধিপত্ত মোকাবিলার অন্যতম প্রধান উপায়। দেশীয় শিল্প, কৃষি ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও অসম চুক্তি এড়িয়ে চলা একান্ত প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য। স্বচ্ছ নির্বাচন, সক্রিয় সংসদ এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা না থাকলে বিদেশি প্রভাব সহজেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।

৬.২ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে মুক্তির কৌশল

সামাজিক পর্যায়ে আধিপত্ত মোকাবিলার জন্য সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা জোরদার করা জরুরি। ভাষা, ইতিহাস এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং বাহ্যিক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

একই সঙ্গে গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সমালোচনামূলক চিন্তার চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। এতে আধিপত্তের সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ রূপগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে।

৭. পরবর্তী প্রজন্মের ভূমিকা

পরবর্তী প্রজন্মই একটি জাতির ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা নির্ধারণ করে। আধিপত্ত নির্মূল ও প্রতিরোধে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সচেতন, শিক্ষিত ও প্রশ্নমুখর তরুণ সমাজ ছাড়া কোনো জাতি দীর্ঘদিন স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন থাকতে পারে না।

প্রথমত, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের নিরপেক্ষ ও গভীর পাঠ নিশ্চিত করা জরুরি। বিকৃত বা অসম্পূর্ণ ইতিহাস মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভ্রান্ত করে এবং পরোক্ষভাবে আধিপত্তকে বৈধতা দেয়।

দ্বিতীয়ত, সমালোচনামূলক চিন্তা ও যুক্তিবোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে কোনো বিদেশি ধারণা, সংস্কৃতি কিংবা নীতি অন্ধভাবে গ্রহণ না করে তা জাতীয় স্বার্থ ও বাস্তবতার আলোকে বিচার করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

তৃতীয়ত, গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রোপাগান্ডা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য আধিপত্তের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সত্য ও মিথ্যা যাচাইয়ের সক্ষমতা না থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম সহজেই প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।

সবশেষে, নাগরিক দায়িত্ববোধ, নৈতিক দৃঢ়তা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তোলাই আধিপত্তের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

৮. বিশ্ব ইতিহাসে আধিপত্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ

৮.১ আফ্রিকা

ইউরোপীয় শক্তিগুলো দীর্ঘ সময় ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্ত প্রতিষ্ঠা করেছিল। উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরও ঋণনির্ভরতা, বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব এবং সামরিক সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে সেই আধিপত্ত অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপে টিকে রয়েছে।

৮.২ লাতিন আমেরিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রেখেছে। অনেক গবেষক এই বাস্তবতাকে ‘নব্য-ঔপনিবেশিক আধিপত্ত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন।

৮.৩ মধ্যপ্রাচ্য

তেল ও জ্বালানি সম্পদকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব, সামরিক উপস্থিতি এবং কৌশলগত হস্তক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্তের সুস্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৮.৪ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

উপনিবেশ-পরবর্তী সময়েও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্তের মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থা ও প্রভাবশালী সংস্কৃতির বিস্তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

উপসংহার

আধিপত্ত বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বা সাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা নয়; বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী, কাঠামোগত ও বহুমাত্রিক ক্ষমতাব্যবস্থা, যা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং জনগণের মানসিক কাঠামো পর্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের ইতিহাস এই বাস্তবতার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।

পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্তের শিকার হয়েছিল। ভাষা, অর্থনীতি, প্রশাসন ও সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রে বৈষম্য ও শোষণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও সুসংগঠিত। এই আধিপত্তের অবসান ঘটলেও তার অভিঘাত ও ঐতিহাসিক শিক্ষা আজও রাষ্ট্রচিন্তা ও নীতি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একই সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে আধিপত্ত কেবল প্রত্যক্ষ শাসনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব—এসব বিষয়ে যে অসমতা ও নির্ভরতার প্রশ্ন ওঠে, তা আধিপত্তের পরোক্ষ ও সূক্ষ্ম রূপকে সামনে নিয়ে আসে।

এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হয় যে, আধিপত্তের চরিত্র পরিবর্তনশীল। সময় ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে এটি নতুন নতুন রূপ ধারণ করে, এবং সেই অনুযায়ী প্রতিরোধের কৌশলও হতে হয় সচেতন, বহুমাত্রিক ও যুগোপযোগী।

হক মো. ইমদাদুল, জাপান: লেখক, সংগ্রাহক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 + 5 =