আপনি কি গরু না ছাগল

মাহবুব আলম

আর মাত্র কয়েকদিন বাদে, এই মাসেই অনুষ্ঠিত হবে কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদ মানেই ঈদের নামাজের পর গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট কোরবানি। এই কোরবানিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্থানে গরু-ছাগলের হাট। অবশ্য, ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য নগরীতে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হাট শুরু হয়নি। তবে এ উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা তাদের সংগৃহীত গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা নিয়ে নগরীর উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। সেইসাথে বিভিন্ন খামারিরা পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার শুরু করে দিয়েছে। অনেকেই আবার ইউটিউবে গরুর বর্ণনা দিয়ে দাম হাঁকতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত আমার চোখে যা পড়েছে তা হলো – গরুর দাম ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা। এসবই মোটা-তাজা করা গরু। আমি গরুর দামের কথাই বলছি; কারণ কোরবানিতে গরুর পাশাপাশি ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট কোরবানি দিলেও আলোচিত হয় মূলত গরু। গরুর আকার আকৃতি রঙ দাম। সেই সাথে দেশি গরু না ভারতীয় অথবা বার্মিজ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডের বিভিন্ন নামের বিভিন্ন প্রজাতির গরুর কথাও শোনা যায়। শুধু তাই নয়, সুদূর ল্যাটিন আমেরিকা থেকেও কার্গো বিমানে আসে গরু। এ নিয়ে চলে তুমুল আলাপ আলোচনা হৈ হুল্লোড়। সেই সাথে চলে কোন বাজারে কত দামের গরু উঠেছে। আর কারা সেই গরুর ক্রেতা। শুধু তাই নয়, গরুর সাথে গরু ক্রেতার ছবিও ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়। দেখানো হয় বিভিন্ন টেলিভিশনে। এখানেই শেষ নয়, ওই ক্রেতা-বিক্রেতা ও গরুর ভিডিও করা হয় এনড্রয়েড ফোনে। তারপর তা প্রচার করা হয় গর্বের সঙ্গে মহা আনন্দে। এতে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতা শুরু হয় অন্যদিকে অনেক ধনাঢ্য ক্রেতার মন খারাপ হয় সেরা গরুটা কিনতে না পারার জন্য। অবশ্য, বিকল্প হিসেবে অনেক ক্রেতা দ্রুত ছুটে যান উট কিনতে। সেই উটের ভিডিও আবার নতুন মাত্রা লাভ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হাজার হোক মরুভূমির উট, আরব দেশের উট। তাই এতে কিছুটা হলেও অনেকের ইজ্জত রক্ষা হয়। সেই উট যদি ভারতের রাজস্থানের হয় তাতেও সমস্যা নেই।

এই ইজ্জত রক্ষা আর প্রদর্শনী চলেছে অনেককাল যাবত। আমরা ছোটবেলায় পাকিস্তান আমলে আমাদের মহল্লা দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে এটা দেখেছি বছরের পর বছর। সে সময় আমাদের মহল্লায় সবচেয়ে ধনী লোক ছিলেন হাজী সালাউদ্দিন, সালু হাজী। আমার মনে আছে কোরবানির ঈদের দুদিন আগে থেকে তার বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর ৩/৪টা বড় গরু বাঁধা থাকতো। সালু হাজী ছাড়াও হোসেন মিয়ার বাড়ির সামনেও একইভাবে কয়েকটি গরু দেখা যেত। সেই সময় সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। হাতেগোনা কয়েকজন গরু কোরবানি দিত। তাই পুরো মহল্লায় চর্চা হতো কে কয়টা গরু কিনেছে। গরুগুলো দেখতে কেমন। আমরা পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে গিয়ে দেখতাম এসব। শুধু আমরা ছেলেরা নয়, অনেক বয়স্ক মানুষকেও দেখেছি ঘুরে ঘুরে গরুগুলোকে দেখতে। সেইসঙ্গে আরো দেখেছি, হঠাৎ করে কোনো একটা বাড়ির সামনে বিশাল সাইজের একটা গরু। এটা দেখে রীতিমত প্রতিযোগিতা করে আরো বড় গরু কেনার ঘটনা ঘটেছে। সেই প্রতিযোগিতা আজও অব্যাহত আছে। তবে এখন এতো বেশি মানুষ কোরবানি দেয় যে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে আগের মতো চর্চা হয় না। তবে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো, অতীতে এই প্রতিযোগিতা হতো মূলত ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এখন এই প্রতিযোগিতা হয় প্রধানত নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে। সর্বত্র চর্চা হয় কোন এমপি, কোন মন্ত্রী কয়টা গরু, কয়টা খাসি কিনেছে। কয়টা গরু-খাসি কোরবানি দিয়েছে।

এবার আসা যাক ঈদের দিনে। কোরবানি দেওয়ার পর গরুর আস্ত রানগুলো পাঠানো হয় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি আর ছেলের শ্বশুর বাড়িতে। আর এ নিয়েও চলে চর্চা। তারপর কোরবানির গোশতে গরিব মানুষের ভাগ বা হক আছে, তাও তারা কমবেশি পূরণ করে। পুরান ঢাকায় এটা ভালোভাবে পূরণ হলেও নতুন ঢাকায় এটা পূরণ হয় হাঁক-ডাক, হৈ-হুল্লোড় আর গলা ধাক্কা দিয়ে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। কার্যত নতুন ঢাকার বাড়ির দারোয়ান বা সিকিউরিটি গার্ডদের বলা হয়, ‘ভিক্ষুকদের লাইন করতে বলো’। কার্যত নতুন ঢাকার গরিবদের মধ্যে নয়, মাংস দেওয়া হয় ভিক্ষুকদের মধ্যে। ভীষণ নিচু মানসিকতার পরিচয় দেখা যায় কোরবানির সময়।

এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয় যে, একসময় নোয়াখালীতে কোরবানি দেওয়ার পর গরুর আস্তো মাথা পাঠিয়ে দেওয়া হতো মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। সেই সঙ্গে আলু, পিঁয়াজ, মসলা ইত্যাদি। বিশেষ করে মাইজদী-সোনাপুর অঞ্চলের ওই রেওয়াজ ছিল দীর্ঘদিন। এখনো কম-বেশি এই দৃশ্য দেখা যায়।

দিনশেষে সন্ধ্যায় শুরু হয় ফেসবুকে একের পর স্ট্যাটাস দেওয়া। এটা শুরু হয় গরু-ছাগল বা ভেড়া কেনার পর থেকেই। সেই সাথে দেওয়া হয় ভিডিও। তবে কোরবানি দেওয়ার পর সেই কোরবানির মাংস বিতরণ, রান প্রেরণ, বন্ধু আত্মীয় পরিবেষ্টিত অবস্থায় মাংস খাওয়ার ছবি ও ভিডিও পোস্ট শুরু হয় সন্ধ্যার পর থেকে। সেইসাথে মামা-চাচা-খালাসহ বন্ধুরা কে কি কোরবানি দিল তার খোঁজখবর করা ও তাই নিয়ে মুখরোচক আলোচনা। দীর্ঘ চর্চা।

আর অবশ্যই এই খোঁজখবর নেওয়া হয় ফোন করে। তাই দিনের শেষে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে, ‘আপনি কি গরু না ছাগল?’ এটা মামা-চাচা-খালা বা যেকোনো পরিচিত জনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বন্ধুদের ক্ষেত্রে হলে বলে, কিরে তোরা কি গরু না ছাগল।

এটা অনেকটা পাকিস্তান আমলে গভর্নর মোনেম খানের বক্তৃতার মতো। কথিত আছে পাকিস্তান আমলে গভর্নর মোনেম খান কোনো এক জনসভায় গিয়ে বলেন, আপনারা হাঁস, আপনারা মুরগি, আপনারা গরু, আপনারা ছাগল…। ততক্ষণে মাঠে সমবেত জনতা রেগে অপমানে লজ্জায় মরে যায় আর কি। ঠিক এই সময় মোনেম খান ঢোক গিলে বলেন, পালন করুন। আসলে ছাগল বলার পর একটু দম নিয়ে বলেন পালন করুন। সেই সময় মোনেম খানের ওই বক্তৃতা ব্যাপক আলোচিত হয়। ঠিক একইভাবে অনেকদিন ধরে দেখছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের দুষ্টু আর রসিকজনরা সুযোগ বুঝে আন্টি আর আংকেলদের বোকা বানাতে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি গরু না ছাগল? এটা শুনে ওই জনসভার শ্রোতাদের মতই আন্টি আংকেদের আক্কেল গুড়ুম। অবশ্য ঢোক গিলে বুঝে ফেলেন আসলে কি জানতে চায় তাদের তরুণ প্রজন্ম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 1 =