আবিদা সুলতানা: কণ্ঠে যার সুরের ইন্দ্রজাল

অলকানন্দা মালা

‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার, মৌনতার সুতোয় বোনা, একটি রঙ্গিন চাদর, সেই চাদরের ভাজে ভাজে, নিশ্বাসেরই ছোঁয়া…’ গানটি শুনলেই ভেসে উঠবে আবিদার সুলতানার মুখ। এক সাবলীল অথচ সুমধুর সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে আছেন সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে।

জন্ম ও সঙ্গীতশিক্ষা

দেশের জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পীর জন্ম পঞ্চগড়ে। একটি সংস্কৃতিবান্ধব পরিবারে জন্মান তিনি। ফলে সংস্কৃতির সঙ্গে সখ্যতা শৈশব থেকেই। তার নানার বাড়ি ছিল শান্তিনগর। সে বাড়িতে গান বাজনা লেগেই থাকত। নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নতুন বছরের প্রথম দিন সব কিছুকেই বরণ করে নেওয়া হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ফলে দুই তিন মাস পরপরই বাড়ির বারান্দায় ঘরোয়া পরিবেশে জমতো অনুষ্ঠান। সেসবে অংশ নিতেন আবিদা সুলতানার মামা খালা মামাতো খালাতো ভাই বোন সবাই। বাবা-মাও থাকতেন সেই আয়োজনে। তিনি নিজেও থাকতেন। কখনও নাচতেন আবার কখনও আবৃত্তি করতেন। কখনও মঞ্চও সাজাতেন। ফলে ওই বয়স থেকেই শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সখ্যতা শুরু। তবে শৈশবে গানের চেয়ে নাচের দিকেই টান বেশি ছিল আবিদা সুলতানার। কিন্তু মায়ের অমতের কারণে নাচের ঘুঙুর তুলে রেখে আবিদা সুলতানা মনযোগ দেন গানে। এই কণ্ঠশিল্পী সঙ্গীতে তালিম নেন বাবু রাম গোপাল মহন্ত, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ, আক্তার সাদমানি, বারীন মজুমদার, ওস্তাদ নারু এবং ওস্তাদ সগীর উদ্দীন খান প্রমুখ গুণী সঙ্গীতসাধকের কাছে।

মায়ের প্রচেষ্টা

মেয়ের গানে মনোযোগ ও আগ্রহ বেশি ছিল আবিদা সুলতানার মায়ের। শহরের কোথায় কোথায় সঙ্গীতবিষয়ক প্রতিযোগিতা হবে সব খবর রাখতেন। নির্ধারিত দিনে মেয়েকে নিয়ে হাজির হতেন। সেসব প্রতিযোগিতায় মেধার স্বাক্ষর রেখে ভালো অবস্থানে থাকতেন গায়িকা। এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে বেতার টেলিভিশনে নিয়মিত গান শুরু করেন। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে গানের শুরুটা আবিদা সুলতানার ওখান থেকেই। সিনেমায় প্লেব্যাকও করা হয়েছিল ছোটবেলায়। প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলেন ‘নিমাই সন্ন্যাসী’ নামের সিনেমার গানে।

পড়াশুনা

আবিদা সুলতানা স্কুলজীবন পার করেছেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কলেজে। তবে মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়ে সঙ্গীত কলেজে পড়বে। সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ থেকে নাম কাটিয়ে আবিদা ভর্তি হন মিউজিক কলেজে। পরে সেখান থেকেই স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি।

সঙ্গীতে বিচরণ

ছোট বয়সে সিনেমায় প্লেব্যাক করলেও পেশাগতভাবে সিনেমায় গান শুরু করেন আবিদা সুলতানা ১৯৭৪ সালে। কণ্ঠ দেন ‘সীমানা পেরিয়ে’ সিনেমার গানে। তখন সবে ম্যাট্রিক পাস করেছেন তিনি। এরইমধ্যে একদিন ছবির পরিচালক আলমগীর কবীর এসে জানান, তার সিনেমায় আবিদাকে গাইতে হবে। আবিদা সুলতানা তখন একেবারেই নতুন। পরিচিতিও তেমন নেই। ওদিকে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, শাহনাজ রহমাতুল্লাহরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সঙ্গীতাঙ্গন। তাদের জনপ্রিয় গানেরও অভাব নেই। তারপরও কেন আবিদা সুলতানাকে দিয়ে গান গাওয়াতে চাইলেন পরিচালক আজও তার কাছে অবাক মনে হয়। ভাগ্যে বিশ্বাসী গায়িকা ভাবেন ভাগ্যই তাকে এভাবে সঙ্গীতাঙ্গনে এনেছে। তবে এই গান নিয়ে গল্প এখানেই শেষ নয়। গানটি ছিল আবিদার বিখ্যাত গান ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার…’। সুরকার ছিলেন কিংবদন্তি ভূপেন হাজারিকা। শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই বয়সে এত বড় সঙ্গীতজ্ঞের সুরে গাইবেন! পরে কলকাতায় উড়ে যান গানটির জন্য। দেখা হয় ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে। প্রথম দিন আবিদাকে গান তুলে দেননি ভূপেন হাজারিকা।

শুধু গানের কথা হাতে দিয়েছিলেন। এটি ছিল মূলত অসমিয়া একটি কবিতা যা পরে বাংলায় রূপান্তরিত করা হয়। ভূপেন হাজারিকার পরামর্শমতো সেদিন কবিতাটি আবিদা পড়েন অর্থ বোঝার জন্য। কিন্তু অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হন। বিষয়টি পরদিন ভূপেন হাজারিকার কাছে চেপে যান তিনি। অর্থ না বুঝেই গানটিতে কণ্ঠ দেন। রেকর্ডিংয়ে বেশি সময় লাগেনি। দুই বারেই সম্পন্ন হয়। এভাবেই কালজয়ী গানটি কণ্ঠে তোলেন আবিদা সুলতানা। সেদিন আবিদের কণ্ঠ মুগ্ধ করেছিল ভূপেন হাজারিকাকেও। তিনি ভূয়সী প্রশংসার পর একটি ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন গায়িকাকে। পরে এই গান দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা এনে দেয় আবিদা সুলতানাকে। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সত্তর আশির দশকে প্লেব্যাকের জগত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আবিদা সুলতানা। সে সময় যে গানগুলো কণ্ঠে তুলেছেন তার অধিকাংশই হয়েছে কালজয়ী।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার

ক্যারিয়ারে অনেক সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এই গায়িকা। এরমধ্যে ‘সীমানা পেরিয়ে’ ‘ইয়ে করে বিয়ে’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘আলো তুমি আলেয়া’, ‘তালুকদার’, ‘ফেরারী বসন্ত’, নান্টু ঘটক’ ‘উজানভাটি’, ‘বাজিমাত, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘এখনই সময়’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘আখেরী নিশান’, ‘সুদ আসল’, ‘পুরস্কার’, ‘তৃষ্ণা’, ‘বানজারান’, ‘রাধাকৃষ্ণ’, নিমাই সন্ন্যাাসী’, ‘জন্মদাতা’, ‘মান অভিমান’, ‘মিলনতারা’, ‘মরণপণ’, ‘রাঙাভাবী’, ‘পাগলী’, ‘রাজমহল’, ‘খোঁজখবর’, ‘উজ্বল সূর্যের নিচে’, ‘সোনার নাও পাবনের বৈঠা’, ‘দুস্যু ফুলন দেবী’, ‘মহুয়া সুন্দরী’, ‘অগ্নিসাক্ষর’, ‘দস্যুরাণী’, ‘ঈমান’, ‘বৌমা’ ‘মরণের পরে’, ‘তাজ ও তলোয়ার’, ‘জীবনের গল্প’ উল্লেখযোগ্য।

আক্ষেপ

আবিদা সুলতানা দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীদের একজন। তার কণ্ঠ সমৃদ্ধ করেছে সঙ্গীতাঙ্গনকে। একটা দোলনা যদি, বিমূর্ত এই রাত্রি আমার, হৃদয়ের অচেনা দুটি নদী, হারজিত চিরদিন থাকবেই, হাতে থাক দুটি হাতসহ গুণী এই গায়িকার রয়েছে অনেক জনপ্রিয় গান। যার মধ্যে কয়েকটি কালোত্তীর্ণ। তারপরও মেলেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে আফসোস করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি তাকে। তিনি লিখেছিলেন, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে অনেক সময় জুরি বোর্ডের কান পর্যন্ত ভালো গানের কথা পৌঁছায় না। অনেক ভালো ভালো গান করা হয়েছে ফিল্মের জন্য। কিন্তু ফিল্ম হিট না করায় সেগুলো নজরে আসেনি। এভাবে অনেক গান চাপা পড়ে গেছে। এছাড়া কিছু সমস্যা তো আছেই। আমার সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে আমি সেটা বলতে চেয়েছি।’

সংসার

সুরের পাখি আবিদা সুলতানা আজীবন পথ চলেছেন সঙ্গীতের হাত ধরে। বিবাহিত জীবনেও পথ চলেছেন সুরের মানুষ জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী রফিকুল আলমের হাত ধরে। তারা একে অন্যের হৃদয়ে দোলা দিয়েছিলেন। প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৭৩ সালে। এক সঙ্গীত সম্মেলনে দেখা হয়েছিল দুজনায়। পণ্ডিত বারীন মজুমদার ও সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী পল্টনে সেই সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তবে সেখানে দেখা হলেও দুজনের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। একে অন্যের মনে দোলা দেন একটি গানে কণ্ঠ দেওয়ার সময়। ওস্তাদ মীর কাশেম খানের সুরে ‘দূরের আকাশ’ শিরোনামের দ্বৈত গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবিদা সুলতানা আর রফিকুল আলম। সেদিন গাইতে গিয়ে আবিদা সুলতানার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন রফিকুল আলম। পরে বুঝতে পারেন কণ্ঠের মতো তার মনটাও খুবই সুন্দর। তবে শুরুটা হয়েছিল বন্ধুত্ব দিয়ে। আবিদা সুলতানার দূর সম্পর্কের মামার আমন্ত্রণে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন রফিকুল আলম। মূলত কাছে আসাটা ওখান থেকেই। সেই সঙ্গে চেনাজানা ও সম্পর্কের শুরু। তবে প্রেম থেকে পরিণয় খুব একটা সময় না নেননি আবিদা সুলতানা ও রফিকুল আলম। সম্পর্কের বছর চারেক পরই দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেন তারা। তবে বিয়ের আগে একটি কাণ্ড করে বসেছিলেন আবিদা সুলতানা। টানা তিন-চার বছর প্রেম করলেও বিয়ে নিয়ে যখন কথাবার্তা হচ্ছিল তখন আবিদা সুলতানা খেয়াল করলেন এই কয়েক বছরের রফিকুল আলম তাকে কোনো চিঠি লেখেননি। বিষয়টি প্রেমিকা হিসেবে মানতে পারেননি তিনি। চিঠি লিখতে বলেছিলেন। নইলে বিয়ে পিছিয়ে দিবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। পরে চিঠি লিখে আবিদা সুলতানার মান ভাঙিয়েছিলেন রফিকুল আলম।

সংসার জীবনের চার যুগ পার হয়ে গেছে আবিদা সুলতানার রফিকুল আলমের। ঘরে এসেছে একমাত্র পুত্র সন্তান ফারশীদ আলম। বাবা মায়ের মতো তিনিও সঙ্গীত নিয়েই আছেন। ঘরে পুত্রবধূ এনেছেন আবিদা সুলতানা। ফারশীদের স্ত্রী সাদিয়া খালিদ রীতি সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্চনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × 5 =