সালেক সুফী: আমি আর আমার জীবন সঙ্গী রোজি ফুলচাষি। যখনি যেটুকু জমি যেখানেই পাই ফুল ফোটাতে চেষ্টা করি। আমি শক্তি পেয়েছি আমার মা মরহুম ইফ্ফাত আরা বেগমের কাছ থেকে। সেই কিশোর বয়সেই মায়ের সাথে ‘ইফাত মঞ্জিলে’ জিনিয়া, দোপাটি, কসমস ডালিয়া, বেলি, জবা, হাসনা হেনা কত ফুল ফুটিয়েছি। বাগানে যতক্ষণ থাকি ফুলের মাঝেই মাকে দেখি। মা বলতেন মানুষ মরে গেলে ভালো মানুষগুলো নাকি তারা হয়ে আকাশে জ্বলে। আমি এখন মন খারাপ হলে তারায় তারায় মাকে খুঁজি।
আমার পরম সৌভাগ্য আমার জীবন সঙ্গিনী রোজি’রও ফুল ফোটানোর নেশা আছে। বিয়ের পর কুমিল্লায় আমাদের বিজিএসএল কমপ্লেক্সে রোজির অনুপ্রেরণায় সুন্দর ফুলের বাগান করেছিলাম। বাগান করেছিলাম ফৌজদারহাট সিজিএস, ডেমরা সিজিএস এমনকি প্রতিটি টিবিএএসে। এর পর যখন উত্তরায় বাসা ভাড়া নিলাম ৩ নম্বর সেক্টরে তখন আমার বাসার ছাদে ৪০ জাতের গোলাপ ফুটিয়েছিল রোজি। সহকর্মীরা দেখতে এসে মুগ্ধ হতো।
অন্যদিকে আশুগঞ্জ, বাঘাবাড়ি আমার লাগানো ফুল গাছগুলোতে নাকি এখনো ফুল ফোটে। বিভিন্ন জাতের ফুল গাছ আমি নিজ হাতে লাগিয়েছিলাম। ২০০৫ সালের অগাস্ট বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া চলে আসার পর দীর্ঘদিন আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ছেলেদের নিয়ে রোজি মেলবোর্ন থাকলেও আমাকে ব্রিসবেন, এডিলেডে, পার্থ, থাইল্যান্ড, কাতার, দুবাই, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, তাঞ্জানিয়া, ভারত যেতে হয়েছে জীবিকার তাগিদে। ২০১৪ রোজির ওপেন হার্ট সার্জারি হলো, দুটো কৃত্রিম ভালভ বসানো হলো। কয়েক বছর আমি ওকে ছেড়ে লম্বা সময় অস্ট্রেলিয়ার বাইরে যাইনি।
২০১৮ থেকেই দেখলাম বাগান করার নেশা আবারো ওর মাঝে ফিরে এসেছে। দূর থেকে উৎসাহ দিলাম। আমাদের সব প্রতিবেশী রোজিকে অনেক লাইক করে। কোথা থেকে কিভাবে কয়েক মাসের মধ্যে হাজার খানেক বিভিন্ন জাতের নাম জানা না জানা ফুল গাছ লাগালো। আমি জানি পাথরেও ফুল ফোটাতে জানে রোজি। গোলাপ গাছ আছে ৩৫-৪০ জাতের। ২০১৯ থেকেই বাগান ফুলে ফুলে অপরূপ হয়ে উঠলো। করোনার গৃহবন্ধি সময়ে বুঝলাম কেন ইংরেজ কবি William Wordsworth লিখেছেন। “A thing of beauty of beauty is a joy for ever “. আমার এই দুই বছর কেটেছে অস্থিরতায়। বাংলাদেশেই হয়তো যেতাম দুই তিন বার। ভারতেও কিছু কাজ করছিলাম।
আমাদের বাগানের শত ফুল দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে সব প্রতিবেশী। শিশুরা এসে ছবি তুলে। আমি যখন রোজ সকালে, রোদেলা দুপুরে বাগানে বসে বই পড়ি বা ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসি। রঙিন প্রজাপতি ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়, কত যে রং বেরঙের পাখি আসে। রোজি বেচারি অনেক ওষুধ খায় বলে ঘুম থেকে উঠতে দুপুর পেরিয়ে যায়। আমি ফুলগুলোর ছবি তুলি। গেলো দেড় বছর কত ছবি তুলে ফেসবুক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছি।
মনে মনে ভয় ছিল যখনি যেখানে অনেক ফুল ফুটেছে আমাদের কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছে। আমাদের ছেলে শুভ্র এখন ব্রিসবেন থাকে। দুটো ফুলের মতো ফুটফুটে নাতি আছে আমাদের। প্রতি বছর অন্তত দুই বার ওদের দেখতে যাই। এখন আমি অবসর নিয়েছি। আমাকে এবং রোজিকে অস্ট্রেলিয়া সরকার অবসর ভাতা দিয়েছে। সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে ছাড় পাই অনেক কিছুতেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম হুট করেই নাতিদের কাছে চলে যাবো। লোগান সিটি কাউন্সিলে শুভ্রর বাসার ১৫ মিনিটস ড্রাইভিং ডিসটেন্স। বিশেষ বিবেচনায় স্বল্প ভাড়ায় বাড়ি পেলাম। অগাস্ট মাসেই সেখানে যাবার সব কিছু ঠিক হলো। করোনার কারণে এতো দিন যেতে না পারলেও যাচ্ছি ১২ অক্টোবর। ১৬ বছর পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর মেলবোর্ন আমাদের চির চেনা রিংউড, অনেক স্বাদের ফুল বাগান ছেড়ে আমরা দুই ফুল চাষি উড়ে যাব গোল্ডকোস্ট ১২ অক্টোবর খুব সকালে। আমাদের বাহারি ফুলের রূপে অপরূপ পুষ্প স্বর্গ ছেড়ে চলে যাবো ২৫০০ কিলোমিটার দূরে আমাদের আরো দুটি ফুটন্ত ফুল জাহির আর ফাতিমার কাছে। ফুল চাষিরা আবারো নতুন বাগানে ফুল ফোটাবে ইনশাআল্লাহ।