‘ইউক্রেন যুদ্ধ: আমেরিকা ও মুসলিম বিশ্ব’ গ্রন্থটি পড়া আবশ্যক

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মাহবুব আলম একটি বই লিখেছেন। ‘ইউক্রেন যুদ্ধ: আমেরিকা ও মুসলিম বিশ্ব’ শিরোনামের এই বইতে তিনি ইউক্রেনের রাজনৈতিক ইতিহাস ও ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষীদের ওপর জাতিগত নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই সাথে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও ভাষার অধিকারের দাবিতে কীভাবে লুহানস্ক ও দোলাস্কের জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করলো তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সাধারণভাবে আমরা ইউরোপের বড় বড় শক্তিধর দেশগুলোর অনেককিছু জানলেও ইউক্রেনের মতো এমন অনেক দেশ আছে তাদের খোঁজখবর কমই রাখি। কমই জানি। সেই রকমই একটা দেশ ইউক্রেন।

পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি রাশিয়ার গা-ঘেঁষা একটি দেশ। এই দেশটিতে প্রভাব বিস্তার করতে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে কীভাবে সে দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে পশ্চিমারা তাদের অনুগত সরকার কায়েম করে সেই বর্ণনা দিয়ে মাহবুব আলম বলেছেন, কার্যত সেই থেকে ইউক্রেন সংকটের শুরু হয়। এবং তার পরিণতিই ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের জন্য তিনি ন্যাটোকে দায়ি করেছেন। তিনি বলেছেন, যুদ্ধের কারণ ন্যাটো। ন্যাটোর উস্কানি। ন্যাটোই যুদ্ধের আর্কিটেক্ট। যদিও ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। তারপরও আসল ভিলেন ন্যাটোই। তিনি এটা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এই মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ বিচার-বিশ্লেষণ করে এই যুদ্ধের বিপজ্জনক দিক তুলে ধরে মন্তব্য করে যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কেও একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যে থেকেই বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।

এই যুদ্ধকে অনেকে দেশ দখলের, ভূখণ্ড দখলের যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মাহবুব আলম সেই দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এই যুদ্ধ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনিবার্য সংঘাতের পরিণতি। যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, বিশ্ব একক শক্তির পদানত হবে, নাকি ক্ষমতার ভারসম্যের ক্ষুদ্র সামর্থের দেশগুলোও মাথা উঁচু করে থাকবে তা নির্ধারণ করবে এই লড়াই।

এটার সবার জানা যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই সঙ্গে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভসহ পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার কয়েক হাজার কোটি ডলারের সম্পদ আটক করে। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব প্রায় শত কোটি বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেয় ইউক্রেনকে। এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেন, কার্যত রাশিয়াকে লড়তে হচ্ছে ন্যাটোভুক্ত দেশসহ ৪২টি দেশের বিরুদ্ধে। তাছাড়া অর্থনৈতিক যুদ্ধও একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বিশ্বের দুই পরাশক্তির এই যুদ্ধ পৃথিবীতে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছেন।

একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে সব সময় শান্তির স্বপক্ষের একজন মানুষ হিসেবে তার এই উদ্বেগ থাকা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এ যুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করছে বিশ্বের বড় বড় সমর বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এই অবস্থায় তিনি বিচার-বিবেচনা বোধ থেকে যে কোনো উপায়ে শান্তির প্রচেষ্টা গ্রহণের পর জোর দিয়েছেন। আর তাই তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ-এর শান্তি প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। যদিও সেই শান্তি প্রচেষ্টা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তথাপি শান্তি উদ্যোগের প্রতি তিনি আস্থা রেখেছেন। এটাই একজন প্রকৃত শান্তিকামী মানুষের ধর্ম। এটা সাংবাদিকতার ধর্ম। সেই ধর্মকে উর্ধ্বে তুলে ধরার প্রচেষ্টা মাহবুব আলমের মধ্যে বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।

ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরু হলে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভাসগুল বলেন, ইউক্রেন সংকট গোটা বিশ্বকে বদলে দেবে। চাভাসগুলের এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এ বিষয়টা ব্যাপক অনুসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করে লেখক বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফল, এতে বিপদে পড়েছে ইউরোপ। শুধু ইউরোপ কেন, ইউক্রেন যুদ্ধ সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি বিশ্বের শক্তিধর দেশ গ্রেট ব্রিটেনও। তাইতো লিখেছেন, এককালের মহাপরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের অধিকারী গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ তিন বেলা খাবার পাচ্ছে না। সুপারশপগুলোতে খাবার সেই। মাংসের দাম দেড়গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২৫ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক একবেলা না খেয়ে থাকছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য সংকট, জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে পুরো ইউরোপে।

এই অবস্থায় বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী মন্তব্য করে তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব আবারও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবাধীন বিশ্ব। অন্যদিকে চীন, রাশিয়াসহ বাকি বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব শুরু হয় সেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হাতছাড়া হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে, চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে। আজকের বিশ্ব রাজনীতিকে বুঝতে হলে মাহবুব আলমের এই গ্রন্থটি পড়া আবশ্যক বলে আমি মনে করি।

হায়দার আকবর খান রনো: তাত্ত্বিক নেতা। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিবির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen + 17 =