ঈদের কোন সিনেমা কেমন হলো

এবার রোজার ঈদে মুক্তি পেয়েছে ১১টি ছবি। দর্শকমহলে আলোচনায় ছিল চার সিনেমা। রাজকুমার, দেয়ালের দেশ, ওমর, কাজলরেখা; এই চার ছবি নিয়ে লিখেছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

রাজকুমার – হিমেল আশরাফ

এবারের ঈদে সবচেয়ে আলোচনায় ছিল শাকিব খান অভিনীত ‘রাজকুমার’ সিনেমাটি। ভিন্ন এক শাকিব খানের দেখা মিলেছে এই সিনেমায়। নিজেকে ভেঙে একজন অভিনেতা হয়ে ওঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। সিনেমার গল্প সাদামাটা। শাকিব খানের সিনেমার গল্প সবসময় সাদামাটা হয়। সিনেমার প্রথম ভাগ খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। সিনেমার শেষ ৩০ মিনিটে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল গল্পটা। এক তরুণের আমেরিকা যাওয়া নিয়ে সিনেমার গল্প। মূল গল্পের রয়েছে নানা শাখা-প্রশাখা। প্রেম, পারিবারিক সম্পর্ক এবং একজন স্বপ্নবাজ তরুণের বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাত্রার গল্প নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ছবিটি।

একজন তরুণের জার্নি দেখিয়েছেন হিমেল আশরাফ। তালাক প্রথা নিয়ে যে ধর্মান্ধতা রয়েছে সে বিষয়টি পরিচালক ফুটিয়ে তুলেছেন। তারিক আনাম খান, দিলারা জামান, ডা. এজাজ, ফারুক আহমেদ, আহমেদ শরীফ সকলেই স্ব স্ব চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। জুলি চরিত্রে কোর্টনি কফি প্রথমদিকে বেশ ভালো অভিনয় করলেও একপর্যায়ে অতি অভিনয় করে ফেলেছেন। কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ বেশ ভালো লেগেছে।

শাকিব খানের সেরা তিন পারফরম্যান্সের মধ্যে ‘রাজকুমার’ সিনেমার নাম চলে আসবে। তিনি পাবনার আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করেছেন চমৎকারভাবে। ‘মা’ ও ‘বরবাদ’ শিরোনামের গান দুটি বেশ ভালো হয়েছে। সিনেমার অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি একদমই জমেনি, বিজিএম নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল। ক্যামেরার কাজ দারুণ হয়েছে। সিনেমাটি প্রাণ হারায় শুধুমাত্র নায়কের অপমৃত্যুর কারণে।

 

দেয়ালের দেশ – মিশুক মনি

টিজার, ট্রেলার, পোস্টার, গান রিলিজ হওয়ার পর দর্শকমহলে ঈদের যে সিনেমাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সেটি ‘দেয়ালের দেশ’। শরিফুল রাজ-বুবলীর লুক, দর্শকদের সিনেমাটির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলে। দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসার দেখা যায় সিনেমায়। যে প্রেমে বড় ধাক্কা নায়িকার অসুস্থতা ও মৃত্যু। যার পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যই ‘দেয়ালের দেশ’ সিনেমার মূল গল্প। সাড়া জাগানো দৃশ্য হিমঘরে বুবলীর নিথর দেহের পাশে বসে আছেন শরীফুল রাজ। সিনেমার সূচনা এই দৃশ্য দিয়ে।

রাজ-বুবলী জুটি বেঁধে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। নিজেদের চরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে গিয়েছেন তারা। দুজনের মধ্যে ভালো অভিনয় করার প্রতিযোগিতা চলেছে বলা যায়। পর্দায় দুজনের কেমিস্ট্রি ছিল দারুণ। শরিফুল রাজের গেটআপ, মেকআপ, বাচনভঙ্গি, ডায়ালগ ডেলিভারি সবকিছুই ভালো ছিল। বুবলীর অভিনয়ে ইনোসেন্স, কঠোরতা, জীবনের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা; সবকিছু ফুটে ওঠে। বুবলী একজন অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন নায়িকা তকমা ভেঙে। অনান্য শিল্পীরা যখনই পর্দায় এসেছেন নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছেন।

সাহিল রনির ক্যামেরার কাজ চমৎকার। চোখ জুড়ানো দৃশ্য, মস্তিষ্কে গেঁথে থাকার মতো কিছু ফ্রেম। সিনেমার মিউজিক ডিপার্টমেন্ট আরেক মুগ্ধতার জায়গা। ভিন্নরকম একটি গল্প পর্দায় দেখিয়েছেন নির্মাতা মিশুক মনি। সিনেমার খারাপ দিক হচ্ছে খুব ধীর গতি। সিনেমার গল্প, সংলাপ ও চিত্রনাট্য করেছেন নির্মাতা নিজে। অনুদানের সিনেমা মানেই নিম্নমানের নির্মাণ, অভিষেক সিনেমায় সেই তকমা ভেঙে দিলেন এই নবীন নির্মাতা।

ওমর – মোস্তফা কামাল রাজ

সিনেমাটি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এবং চিত্রনায়ক মান্নাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। সিনেমার চরিত্রের নামগুলো চমৎকার লেগেছে। সিনেমায় ছোট মির্জার দেহরক্ষীর নাম ‘বদি’, বড় মির্জার পিএসের নাম ‘মতি’, কাজের মেয়ের নাম ‘ফুলি’। মোস্তফা কামাল রাজের পঞ্চম সিনেমা ‘ওমর’ মার্ডার মিস্ট্রি ঘরানার। নির্মাতা বড় পর্দায় নিজেকে প্রমাণ করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। ‘ওমর’ সিনেমার টিজার, ট্রেলার, পোস্টার দেখে দর্শক খানিকটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ট্রেলারে বলা যায় পুরো গল্প বলে ফেলেছেন নির্মাতা। সিনেমাজুড়ে ট্রেলারের বিষয়গুলো আরেকটু বিস্তারিত দেখা যায়। তবুও সিনেমাটি একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সিনেমার চিত্রনাট্যকার সিদ্দিক আহমেদের বদৌলতে। তার সুনিপুণ লেখনিতে গল্পনির্ভর একটা সিনেমা হয়ে উঠতে পেরেছে। মোস্তফা কামাল রাজের আগের সিনেমাগুলোর চিত্রনাট্যে ছিল অসংখ্য গলদ সেখানে ‘ওমর’ সিনেমার চিত্রনাট্য বেশ গুছানো। সিনেমায় দেখা যায় খুনটা কে করেছে, কেন করেছে, কীভাবে করেছে বা খুন করার পর কী হলো এসব।

অভিনয়ের দিক থেকে শরীফুল রাজ বেশ ভালো পারফরম্যান্স করেছেন। এবারের ঈদে প্রতিটি সিনেমায় তার অভিনয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। নাসিরউদ্দিন খান ‘বদি’ চরিত্রে ভালো করার চেষ্টা করেছেন। কিছু সিকুয়েন্সে অতি অভিনয় করেছেন। শহীদুজ্জামান সেলিম-রোজী সিদ্দিকী জুটি দারুণ পারফর্ম করেছেন। অতিথি চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবুকে আরেকটু স্পেস দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তার মতো জাতশিল্পীকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন পরিচালক। সংলাপ বেশ উপভোগ্য। রাজু রাজের চোখ জুড়ানো সিনেমাটোগ্রাফি মুগ্ধ করেছে। স্যাভি নাভিদদের মিউজিক টেকনিক্যাল পার্টকে বেশ স্ট্রং করেছে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মন্দ বলার সুযোগ নেই। সেকেন্ড হাফের শুরুতে গল্প খানিকটা ধীরগতিতে আগাতে থাকে। নির্মাতা সিনেমার সময়সীমা ২০ মিনিট কমিয়ে আনতে পারতেন। তাহলে জমজমাট একটা মাডার মিস্ট্রি তৈরি করে ফেলা কঠিন ছিল না।

কাজলরেখা – গিয়াস উদ্দিন সেলিম

গিয়াসউদ্দিন সেলিম নির্মিত ‘কাজলরেখা’ সিনেমা লোকসাহিত্যের প্রামাণ্য দলিলে পরিণত হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। লোকসাহিত্য থেকে গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সিনেমাটি। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র সমৃদ্ধ গল্প ‘কাজলরেখা’। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চন্দ্রকুমার দে’র সংগ্রহে এবং ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। লোকসাহিত্যের উপাদানে ছবি নির্মাণ বর্তমান সময়ে অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। কারণ আধুনিকতা শহর থেকে শুরু করে গ্রামের আনাচকানাচে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘কাজলরেখা’ সিনেমার সেট ডিজাইন থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ আবহ এমনভাবে তৈরি করেছেন সেখানে এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। বলতেই হয় সম্পূর্ণ গ্রামীণ আবহে ‘কাজলরেখা’ নির্মিত হয়েছে। সিনেমায় অনেকগুলো গান ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। মিউজিক্যাল ড্রামা ঘরানার সিনেমায় গল্প বলার সবচেয়ে ভালো উপাদান গান। গানের যথার্থ ব্যবহার করেছেন তিনি। সিনেমার সংলাপেও লোকসাহিত্যের দিকটি যত্নের সাথে তুলে ধরেছেন নির্মাতা।

অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গেলে বলতে হয় সাদিয়া আয়মান ও মন্দিরা চক্রবর্তী বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। বড় পর্দায় প্রথমবার কাজ করে নিজেদের প্রমাণ করলেন। শরিফুল রাজ পরিপক্ব অভিনয় করেছেন। নেগেটিভ চরিত্রে মিথিলা দারুণ পারফর্ম করেছেন। খায়রুল বাসারও মন্দ করেননি। শুকপাখি ‘কাজলরেখা’ সিনেমার বিশেষ চরিত্র। নেত্রকোণা, খুলনা, সুনামগঞ্জ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা যায় কামরুল হাসান খসরুর চোখ দিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল অসাধারণ। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম সেজন্য তিনি ধন্যবাদ প্রাপ্য। সিনেমাটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অংশ হয়ে থাকবে বহুদিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 16 =