নাহিন আশরাফ
ভারতের একজন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা মনীশ মালহোত্রা। ফ্যাশনের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে কিন্তু এই নামের সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে তার সুনাম রয়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব সংগীতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাইকেল জ্যাকসন, রিহানা, জেনিফার লোপেজের মতো সেলিব্রেটিরা তার ডিজাইন করা গয়না ও পোশাক পরেছেন। সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়ার পর প্রশংসা পান সকলেই। কিন্তু এর পেছনে পরিশ্রমের গল্প অনেকেই জানেন না, যা নিয়ে মনীশ মালহোত্রা বরাবরই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন।
১৯৬৬ সালে ভারতের মুম্বাইয়ের পাঞ্জাব পরিবারে জন্ম তার। ১৯ বছর বয়স থেকে তিনি মডেলিং শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই তার সিনেমার প্রতি ছিল ভীষণ আগ্রহ। নতুন কোনো সিনেমা রিলিজ হলেই তিনি হলে গিয়ে সে সিনেমা দেখে আসতেন। শুধু যে দর্শক হিসেবে বিনোদনের জন্য সেই সিনেমা দেখতেন তা নয়। সিনেমার গান, ডায়ালগ, কস্টিউম সবকিছু তিনি খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতেন। ছোটবেলায় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কম ছিল, যা তিনি অকপটে স্বীকার করেন। সিনেমা ও ছবি আঁকার প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক ছিলেন। ছোটবেলায় মায়ের শাড়ি নির্বাচনে তিনি সাহায্য করতেন। ছোটবেলায় স্কুল শিক্ষক তার মাকে ডেকে নিয়ে বলেন, আপনার ছেলে তো শুধু জুতা ও জামা নিয়ে আলোচনা করে, পড়ালেখার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। খুব অল্প বয়সে মডেলিং ও মিডিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে যান তিনি। মিডিয়ায় কাজ করার ক্ষেত্রে পরিবারের সমর্থন ছিল। কারণ তারা ভেবেছিলেন মিডিয়ায় কাজ করে সে অভিনয় করবেন, নায়ক হবে। কিন্তু মডেলিং করলেও অভিনয়ের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। বরাবরই তার পোষাক ও ডিজাইনের প্রতি ঝোঁক ছিল। পরিবারকে যখন তিনি জানান তিনি ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে চান তখন শুরুতে তাদের খুব একটা মত ছিল না। কারণ সে সময় ডিজাইনিংয়ে ক্যারিয়ারের সুযোগ ছিল না। তাই তারা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। কিন্তু মনীশ মালহোত্রা কখনো থেমে থাকেননি। কাজ করার সাথে সাথেই যে তিনি সাফল্যের মুখ দেখে ফেলেছিলেন তা নয়। করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। দিনে ১৮ থেকে ১৯ ঘণ্টা তিনি কাজ করতেন। পরিশ্রমকে তিনি কখনো ভয় পেতেন না, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এটা তাকে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারে। মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে তিনি একটি বুটিক হাউসে কাজ শুরু করেন। এতো কম টাকা পাওয়ার পরেও তার কোনো অভিযোগ ছিল না। কারণ তিনি কাজটাকে অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন ডিজাইনিং জগতে কাজ করার জন্য শুধু ভারত নয় তার পুরো বিশ্বের ডিজাইন সম্পর্কে জানতে হবে।
তাই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করা শুরু করেন। তিনি যে দেশেই যেতেন সে দেশের মানুষের স্টাইল, পোশাক লক্ষ্য করতেন। পোশাকের দোকান ঘুরে বেড়াতেন। এভাবেই তিনি একটু একটু করে ফ্যাশন জগতে কাজ করার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। বলা যায় তার সফলতার পেছনের মূল রহস্য হচ্ছে সবকিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং জানার চেষ্টা। ছোটবেলার স্মৃতিচারণে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তার ছোটবেলা জুড়েই রয়েছে শুধু সিনেমা। ডিজাইনার হবার লক্ষ্য নির্ধারণ করার আগে থেকেই তার সিনেমার প্রতি ভালোবাসা ছিল। এই ভালোবাসা থেকেই তিনি কালজয়ী সব সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
বর্তমানে তিনি উদ্যোক্তা কিংবা ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে পরিচিত হলেও তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইনের মাধ্যমে। তিনি মনে করেন আজকে তাকে একটি বিখ্যাত ডিজাইনার হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করেছে সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইনিং। বলিউডের ‘রঙ্গিলা’ সিনেমার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। সে সিনেমায় তিনি পোশাক ডিজাইন করেন এবং তার ডিজাইন করা পোশাক বেশ প্রশংসিত হয়। তিনি মনে করেন ‘রঙ্গিলা’ সিনেমা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মজার ছলে বলেন, তিনি যখন সিনেমায় পোশাক ডিজাইন করতেন তখন তিনি পরিচালকদের অনেক বেশি বিরক্ত করতেন। প্রশ্ন করে তিনি চরিত্রটি বোঝার চেষ্টা করতেন। দেখতে সুন্দর লাগবে এমন একটি পোশাক তৈরি করে ফেললেই হলো না। তিনি মনে করতেন যে চরিত্রের সাথে মিল রেখে তিনি পোশাক তৈরি করবেন। এভাবেই তার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়। এরপর বলিউডে সব বিখ্যাত সিনেমার পোশাক ডিজাইন করেন তিনি। কুছ কুছ হোতা হ্যায়, রাজা হিন্দুস্থানী, দিল তো পাগল হ্যায় ইত্যাদি সফল সিনেমার কস্টিউম ডিজাইনার ছিলেন মনীশ মালহোত্রা।
বলিউডদের সিনেমার বিভিন্ন আইকনিক লুক তিনি সৃষ্টি করেন তিনি। জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রীদেবী তাকে তার ফটোশুট লুক ডিজাইন করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। ৯০ দশকে তার করা বলিউড সিনেমার নায়িকাদের লেহেঙ্গা, শাড়ি, ব্লাউজ ডিজাইনের প্রশংসা হয়ে থাকে আজও। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বলিউড সিনেমায় অসংখ্য ডিজাইন করার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
সিনেমায় ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন এবং সেখানকার সংস্কৃতি ও ফ্যাশন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে সফলভাবে কাজ করতে থাকলেও তিনি কখনো বিয়ের পোশাক ডিজাইন করবেন কিংবা একটি বড় বুটিক হাউস খুলবেন সে কথা ভাবেননি। তিনি লক্ষ্য করলেন তার করা সিনেমায় ডিজাইন করা পোশাকের প্রতি অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং তারা চাইতো তিনি সকলের জন্যই পোশাক ডিজাইন করুক। এরপর তিনি সিনেমায় কস্টিউম ডিজাইনের পাশাপাশি সেলেব্রেটিদের ওয়েডিং পোশাক ডিজাইন করা শুরু করেন। বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী উর্মিলা, কিয়ারা আদবানি, কারিশমা কাপুর, কারিনা কাপুর সহ অনেকে নিজেদের বিয়েতে তার ডিজাইন করা পোশাক পরেছেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মনীশ মালহোত্রার পোশাক স্টোর। পোশাকের পাশাপাশি সেই স্টোরগুলো সাজানো রয়েছে জমকালো ভাবে। স্টোরে প্রবেশ করার সাথে সাথে যে কেউ ডিজাইন দেখে মুগ্ধ হতে বাধ্য। মনীশ মালহোত্রা লেহেঙ্গার পাশাপাশি শাড়ি, মেয়েদের কটি এবং বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন পোশাক ডিজাইন করে থাকেন। তার ডিজাইনে লক্ষ্য করা যায় নান্দনিকতা। এ ছাড়া ভারতের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেন পোশাকে। তার ডিজাইন করা কিছু শাড়ি ও লেহেঙ্গায় দেখা যায় নিখুঁত হাতের কাজ। মনীশ মালহোত্রার নকশা করা পোশাক বিয়েতে পরা অনেক মেয়েদের কাছে স্বপ্ন। পোশাকের স্টোর ছাড়াও তিনি মনীশ মালহোত্রা বিউটি, মনীশ মালহোত্রা জুয়েলারি, হোম ডেকোর, ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি চালান। ফ্যাশন ডিজাইনার ছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি সিনেমা পরিচালক। সিনেমার প্রতি তীব্র ভালোবাসা থাকার কারণে বরাবরই তিনি সিনেমা পরিচালনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
অক্লান্ত পরিশ্রম সৃজনশীলতা ও অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি নিজেকে ভারতের প্রথম সারির ডিজাইনার হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তার পোশাক পরে শুধু ভারতীয় সেলিব্রেটিরা নন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেলিব্রিটিরাও রেড কার্পেটে হেঁটে থাকেন। শুরু থেকেই তিনি ভারতীয় সিনেমার বিভিন্ন পোশাক ডিজাইন করে বিশ্বের বুকে ভারতকে প্রশংসিত করেছেন। এখন তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন বিয়ের পোশাক ডিজাইন করে। ইচ্ছা শক্তি ও পরিশ্রম করতে পারলে একটি মানুষ শূন্য থেকে যে নিজেকে নিয়ে যেতে পারে অনেক উপরে মনীশ মালহোত্রা তার প্রমাণ।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর