দুদিনব্যাপী সেশনের শেষ দিনে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর প্রফেসর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আয় বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। তবে সে তুলনায় ট্যাক্স দেওয়ার পরমিাণ বাড়েনি। মাত্র ১০ ভাগ মানুষ ট্যাক্স দেয়। রাষ্ট্রীয় পুঁজি বাড়াতে হলে ট্যাক্স আহরণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। বর্তমানে মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি, ড্রাগ বড় সমস্যা। এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। দুর্নীতি দমন বিভাগ শক্তভাবে মোকাবেলা করছে। তবে পুঁজিবাদি অর্থনীতিতে দুর্নীতি একবারে বন্ধ করা যাবে না। দেশে ১০০০ কোটিপতি থাকেলও বিনিয়োগ তেমন নেই। ব্যক্তি খাতে মাত্র ১১% বিনিয়োগ হয়। কোটিপতিরা বিনিয়োগ করতে চায় না। শেয়ার মার্কেট বড় করা যায়নি। বছরে ৫-৬ মিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যায়। আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে।
তিনি বলেন, পদ্মা ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলি টানেল, মেট্রো রেল এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন প্রায় শেষ। প্রকল্প পরিপূর্ণভাবে চালু হলে ১% জিডিপি বাড়বে আর দারিদ্য কমবে ০.৮৫% হারে। এর ফলে বাংলাদেশের ইমেজ আরও অনেক বেড়ে যাবে। অগ্রগামী অর্থনীতির দেশ হিসেবে আমরা মর্যাদা পাব।
আজ (শুক্রবার) ৮ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুম এবং ফেসবুক লাইভ-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত “পঞ্চাশে বাংলাদেশ: অনিশ্চিত যাত্রা থেকে উন্নয়নের রোল মডেল” শীর্ষক দ্বিতীয় দিনের ভার্চুয়াল সম্মেলনে প্রফেসর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত হতে চলেছি। বেশ কিছু এমডিজি গোল আমরা এরইমধ্যে অর্জন করেছি। সামনে নানা ট্যাক্স সুবিধা বাংলাদেশ আর পাবে না। তবে এর ফলে রপ্তানি কমে যাবে এটা আমি মনে করি না। উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে গেলে অনেক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য অংশীদার হতে চাইবে। সাগরে আমরা একটা বিশাল এলাকার মালিকানা পেয়েছি। যা ব্লু ইকোনমির দ্বার খুলে দিয়েছে। যদিও আমরা এখনও এখানে ব্যাপক কাজ শুরু করতে পারিনি। তবে শিঘ্রী সামুদ্রিক মাছ আহরণ, পর্যটন এমন সব সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে কাজ শুরু হলে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।
৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ পুঁজিবাদ নীতি গ্রহণ করে। বাজার অর্থনীতি চালু হয়। নানা রকম উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় ১৫ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টি হযেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ সহ অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্যোগের প্রশংসা করছে। অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু সহ আরও অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ইকোমমিস্ট, ব্লুমবার্গের মতো প্রভাবশালী পত্রিকাও এতে যোগ হয়েছে।
ভোকেশনাল শিক্ষায় জোর দিতে হবে। খুব সম্প্রতি শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আশা করি কয়েক বছরের মধ্যে আমরা এর সুফল দেখতে পাব। আমার পরামর্শ থাকবে দেশের সাধারণ নাগরিকের জন্য ইন্সুরেন্স করা আর সিনিয়র নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা দেয়ার। এছাড়া ঢাকা সিটি সরকার গঠন করা আর সবকিছু অন্তত ৫০ ভাগ বিকেন্দ্রীকরণ করা। বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে শেখ হাসিনা অবশ্যই তা করতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ৪ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়ে গার্মেন্ট খাত চলছে। এর মধ্যে ৬০% নারী। আরও ১০ মিলিয়ন মানুষ এখাতের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। রপ্তানির প্রায় ৮৩% আয় গার্মেন্ট খাত থেকে আসে। বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ১৪৮টি গ্রিন কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪টি প্লাটিনাম, ৯১টি গোল্ড আর ৯টি সিলভার।
আমদের গার্মেন্ট মূলত কটন কেন্দ্রিক, প্রায় ৭৪%। কিন্তু নন-কটনের অনেক বড় বাজার রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ সেক্টর অসুবিধায় পড়ে যাবে। কারণ অনেক রকম ট্যাক্স সুবিধা আমরা আর পাব না। আশার কথা হলো আমরা চীনে গার্মেন্ট রপ্তানি শুরু করেছি। চীনে আমদের সুযোগ আছে।
টেক্সটাইল বর্জ্য একটা বড় সমস্যা। তবে এনিয়ে কাজ হচ্ছে। বেশকিছু কারখানায় ডাইংয়ে আগে যেখানে ৪০০ লিটার পানি ব্যবহার হতো এখন আধুনিক প্রযুক্তি আনায় ১০০ লিটার ব্যবহার হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্ল্যান্ট বসান হচ্ছে। রিসাইক্লিংয়ের এর ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। গার্মেন্ট কারখানা ডিজিটালাউজড হচ্ছে। উন্নত মেশিনারি আনা হচ্ছে। তবে ম্যান পাওয়ার লাগবেই। এক্ষত্রে কাজের সুযোগ কমে যাবে এমন আশঙ্কা নেই।
জাপানের কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুনসুকিমানাগি সেমিনারে বলেন, ইনক্লুসিভ সম্পদ ক্ষেত্রে ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। বৃদ্ধির হার ৩.১%, যা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। বন্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। আর্সেনিক সমস্যা কমিয়ে ফেলেছে। শিল্প ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হয়েছে। ফিজিকাল সম্পদ (রাস্তা, ইমারত, মেশিনারিজ) বাড়ছে। জিডিপি বাড়ছে। তবে প্রাকৃতিক সম্পদ কমছে।
এখন মানবসম্পদ বৃদ্ধিতে মনযোগ দেয়া দরকার। শিক্ষায় সমতা আনতে যারা ঝরে পড়েছে তাদের ভোকেশনার শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ গ্রামীণ জীবনেও শিক্ষা জরুরি। ভোকেশনাল শিক্ষা মানবসম্পদ (শিক্ষা, জ্ঞান) বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশকে ভবিষৎ প্রজন্ম এভাবেই গড়ে তুলতে হবে।
অনলাইনে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সের আয়োজন করেছে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড, ম্যাকুয়ারি ইউনিভার্সিটি, সুগার রিসার্চ অস্ট্রেলিয়া, কুইন্সল্যান্ড হেলথের সিনিয়র শিক্ষক ও গবেষকরা এবং অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক সংগঠন ‘আমরা ক’জন-দি লিগ্যাসি অফ বঙ্গবন্ধু অস্ট্রেলিয়া ইনক।#