মৌ সন্ধ্যা
মুক্তিযুদ্ধেরও বছর দুয়েক আগে অভিনয় জগতে নাম লেখান তিনি। সেই থেকেই ছুটে চলা স্বপ্নীল এই পথ ধরে। মঞ্চ, ছোটপর্দা, বড়পর্দা সবখানেই রেখে গেছেন দক্ষ কারিগরের ছাপ। নাটক পরিচালনা করেছেন। নাটক লিখেছেন। কলাম লিখেছেন। কথাসাহিত্যিকও তিনি। এই সব পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তিনি একজন প্রকৌশলীও। ৭ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তি এই অভিনেতার জন্মদিন। ৭৯ পেরিয়ে ৮০ তে পা রাখলেন চিরসবুজ অভিনেতা আবুল হায়াত। রঙ বেরঙের পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
ভারতে জন্ম, চট্টগ্রামে কৈশোরের ঘ্রাণ
নন্দিত অভিনেতা আবুল হায়াতের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৪ সালে সেখানকার মুর্শিদাবাদে জন্মেছিলেন তিনি। তবে বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে উঠেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। আবুল হায়াতের জন্ম তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। অনেকে তাকে ২৫ জুন উইশ করেন। ভুলটা শুরু হয়েছিল স্কুলে ভর্তির সময়। সার্টিফিকেটে ২৫ জুন জন্মদিন, এটা পালন করেন না অভিনেতা। তার সঠিক জন্মদিন ২৩ ভাদ্র, সেই হিসাবে ৭ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। ১৯৪৭ সালে ওপার বাংলার মুর্শিদাবাদের আদিনিবাস ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে পাড়ি জমান জনাব আব্দুস সালাম। সাথে স্ত্রী আর তিন বছরের ছোট্ট ছেলে আবুল হায়াত। বাবার চাকরিসূত্রে দেশ ভাগের পর আবুল হায়াতের ছেলেবেলা কাটে চট্টগ্রামে। তিনি পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ও রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকায় পাড়ি জমান।
বুয়েটে পড়ালেখা অতঃপর প্রকৌশলী জীবন
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকা চলে আসেন আবুল হায়াত। এরপর ভর্তি হন দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ বুয়েটে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৯৬৭ সালে। তার পরের বছরই চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী পদে চাকরি জীবন শুরু করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও অভিনয়ের প্রতি আলাদা রকমের টান ছিল তার। ১৯৭৮ সালে তাকে কর্মসূত্রে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। বছর তিনেক পর দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৮২ সালে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি কনসালটেন্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। শুরু হয় অন্য এক জীবন।
মঞ্চ থেকেই শুরু
মাত্র ১০ বছর বয়সে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন আবুল হায়াত। তখনই অভিনয়ের ঘোর লেগেছিল মনে। ঢাকায় এসে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার নিজের নাটকের দল ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’। মঞ্চে তার প্রিয় তিনটি নাটক হলো ‘বাকি ইতিহাস’, বাদল সরকারের রচনায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন আলী যাকের। আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনায় ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ ও জিয়া হায়দারের নির্দেশনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’।
মঞ্চে অভিনয় প্রসঙ্গে আবুল হায়াত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি মঞ্চেরই শিল্পী। মঞ্চ থেকে উঠে এসেছি। মঞ্চ আমার প্রাণ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি নাটকের দলের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল সময় কাটিয়েছি, অভিনয় করেছি। মঞ্চের প্রতি আমার আলাদা দরদ ও মায়া আছে। জীবনের প্রথম পুরস্কার মঞ্চে অভিনয় করে পেয়েছি। মঞ্চ আমাকে অনেক দিয়েছে। মঞ্চে ফেরার ইচ্ছে কাজ করে এখনো। কিন্ত শারীরিকভাবে অনেক শক্তির প্রয়োজন। ওটা না হলে সম্ভব নয়। কয়েকদিন পর আমার লেখা নতুন নাটক মঞ্চে আসছে। ওই নাটকে অভিনয় করতে চেয়েছিলাম। কিন্ত পারলাম না।
তারপরও আশাবাদী মানুষ আমি। স্বপ্ন দেখি মঞ্চে ফেরার। মঞ্চ নাটক নিয়ে যেরকম স্বপ্ন দেখেছিলাম বহু আগেই তা পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক অনেক দূর এগিয়েছে। এদেশের মঞ্চ নাটক অনেক দেশে প্রশংসিত হয়েছে। দর্শনীর বিনিময়ে আমরাই প্রথম নাটক করেছি। অনেক ভালো ভালো নাটক আছে আমাদের। আমার নিজের দল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের অনেকগুলো সাড়া জাগানো ও প্রশংসিত নাটক। সেসব নাটকে আমিও অভিনয় করেছি।’
নতুন পথ চলা
১৯৬৮ সালে বুয়েট থেকে পাস করে বের হলেন তিনি। সে সময় ঢাকায় মেসে থাকতেন। এসময় তিনি জানতে পারেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় একটি নাটক তৈরি করবে, যা টেলিভিশনে দেখানো হবে। আমেরিকা থেকে নাট্য নির্মাণের উপর মাস্টার্স করে আসা জিয়া হায়দার সেই নাটকের নির্দেশনা দিবেন। নাটকের নাম ইডিপাস। ১৯৬৯ সালে এই ‘ইডিপাস’ নামের নাটকটি দিয়েই তার অভিষেক হয় টিভি পর্দায়। সেই গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন আবুল হায়াত। তার অভিনীত নাটকের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে।
সিনেমা আর বিজ্ঞাপনেও তার উপস্থিতি সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা নাটক ও সিনেমার ইতিহাসে অনেক উল্লেখযোগ্য কাজের সঙ্গে ছিলেন আবুল হায়াত। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’ এসব নাটকে আবুল হায়াতের অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে দাগ কেটে আছে। এছাড়া নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র ‘মিসির আলি’ রূপে অভিনয় করেও সবার মন জয় করেছেন তিনি।
‘ইডিপাস’-এর পর ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অন্য ভুবনের ছেলেটা’, ‘দ্বিতীয় জন্ম’, ‘শেখর’, ‘অয়োময়’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’ থেকে জোছনার ফুল’, ‘শুকনো ফুল রঙিন ফুল’, ‘আলো আমার আলো’, ‘নদীর নাম নয়নতারা’, ‘খেলা’, ‘শনিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিট’, ‘হাউজফুল’, ‘এফএনএফ’সহ অনেক দর্শকনন্দিত নাটকে অভিনয় করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন আবুল হায়াত। তাকে বলা হয় টিভি নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘বাবা’।
চলচ্চিত্রে আবুল হায়াত
চলচ্চিত্রেও আবুল হায়াত উজ্জ্বল। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় একটি চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। একই বছর ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। তার অভিনীত অন্যান্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘প্রেমের তাজমহল থেকে’ ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘জয়যাত্রা’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘গহীনে শব্দ’, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ প্রভৃতি।
নির্মাতা আবুল হায়াত
নির্মাতা হিসেবেও সফল আবুল হায়াত। তার নির্মিত বহু নাটক দর্শকপ্রিয় হয়েছে। ‘জোছনার ফুল’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ বিখ্যাত নাটকগুলো তারই পরিচালিত। নিজের পরিচালিত ‘জোছনার ফুল’ নাটকে অভিনয়ের জন্য বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।
লেখক আবুল হায়াত
অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখির কাজেও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন আবুল হায়াত। একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি, নাম ‘এসো নীপবনে’। ১৯৯১ সালের বইমেলায় তার প্রথম বই ‘আপ্লুত মরু’ প্রকাশিত হয়। সেই নব্বই দশকের সূচনালগ্ন থেকে তার লেখা বই প্রকাশ হয়ে আসছে। এরপর একে একে প্রকাশ হয় ‘নির্ঝর সন্নিকট’, ‘এসো নীপ বনে’, ‘অচেনা তারা’, ‘জীবন খাতার ফুট নোট’, ‘হাঁসুলি বেগমের উপকথা’, ‘মধ্যাহ্নভোজ কি হবে?’, ‘জিম্মি’, ‘ঢাকামি’, ‘মিতুর গল্প’, ‘টাইম ব্যাংক’, ‘আষাঢ়ে’, ‘রঞ্জিত গোধূলি’ ও ‘প্রিয়-অপ্রিয়’ বইগুলো।
পরিবার
ব্যক্তিগত জীবনে আবুল হায়াত ১৯৭০ সালে বিয়ে করেছেন তার মেজ বোনের ননদ মাহফুজা খাতুন শিরিনকে। এই পরিবারের কাউকেই অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়নি, প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বকীয়তায় পরিচিত। আবুল হায়াতের দুই মেয়ে বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াত মিডিয়ার আলোকিত মুখ। বিপাশা হায়াত দেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী। আবুল হায়াত-মাহফুজা খাতুন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান নাতাশা হায়াত। এমন দারুণ পরিবার তৈরির মূল কারিগর হলেন মাহফুজা খাতুন শিরিন। অভিনেতা তৌকির আহমেদ এবং অভিনেতা-মডেল তারকা শাহেদ শরীফ খান হচ্ছেন আবুল হায়াতের দুই জামাতা।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
অভিনয়শিল্পে অনন্য অবদান রেখে যেমন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তেমন বেশকিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হয়েছে তিনি। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমার জন্য সেরা পার্শ্ব-চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে ২০০৭ সালে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১৫ সালে একুশে পদক পান তিনি।
আজীবন সম্মাননায় আবুল হায়াত
২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর দীপ্ত টেলিভিশন তাদের ৭ম বর্ষপূর্তিতে প্রদান করে ‘দীপ্ত অ্যাওয়ার্ড ২০২২’। দীপ্ত অ্যাওয়ার্ডে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় ‘আজীবন সম্মাননা’। প্রথমবার ‘দীপ্ত অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা’য় ভূষিত হন আবুল হায়াত।
শেষ কথা ও আবুল হায়াতের উক্তি
আবুল হায়াতকে নিয়ে এত অল্পপরিসরে কতটুকুইবা বলা সম্ভব। এক জীবনে তিনি যত কাজ করেছেন, সেসব নিয়ে বলতে গেলে একটি বই লেখা হয়ে যাবে। আরও একবার জন্মদিনের প্রসংগ এনে শেষ করা যাক।
জন্মদিন নিয়ে আবুল হায়াতকে প্রশ্ন করলে সব সময়ই তিনি একটা কথা বলেন, ‘জন্মদিন এলেই মনে হয় আরেকটি বছর জীবন থেকে শেষ হয়ে গেল। এভাবেই জীবনের ইতি ঘটে। বিশেষ দিনটিতে সবার ভালোবাসায় সিক্ত হই। এটাই বিরাট প্রাপ্তি। মানুষের ভালোবাসা জীবনকে আরও আনন্দময় করে তুলে।’
এমনই আনন্দে কাটুক আমাদের প্রিয় অভিনেতা আবুল হায়াতের প্রতিটা দিন। চিরসবুজ অভিনেতা শতায়ু হন, রইলো এই শুভকামনা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা