এক নতুন আলিয়া ভাট

নীলাঞ্জনা নীলা
চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট ও অভিনেত্রী সোনি রাজদানের ঘরে ১৯৯৩ সালে ১৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন আলিয়া ভাট। ১৯৯৯ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় জগতে পা রাখেন। কিন্তু পরিচিতি পান করণ জোহর পরিচালিত ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রে তিনি শানায়া সিংহানিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

শুরুতে অভিনয় নিয়েও অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন তিনি। বলিউডে একটা চিরাচরিত শব্দ হচ্ছে ‘স্টার কিড’। বিখ্যাত মহেশ ভাটের কন্যা হবার কারণে আলিয়ার পথটা অনেকটাই সোজা ছিল। কোনো রকম কাঠ কয়লা পোড়ানো ছাড়াই তিনি কাজ পেতে থাকেন। তাই সমালোচকরা বরবারই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মেরেছেন, আসলেই কি আলিয়া ভাট অভিনয় জানেন? কিন্তু এইসব প্রশ্নের জবাব আলিয়া দিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ অভিনয় দিয়ে। সম্প্রতি তিনি হাজারো ভক্তদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ‘গাঙ্গুবাই’ সিনেমার মধ্যে দিয়ে। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন স্টার কিড হয়ে মিডিয়াতে আসলেও টিকে থাকতে হয় নিজ যোগ্যতায়। ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি’-র চিত্রনাট্য শুনে কী করেছিলেন আলিয়া, তা নিয়ে পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালি বলেন, ‘আলিয়া গল্প শুনে ব্যাগ রেখে পালিয়ে গিয়েছিল’। আলিয়া প্রথমে খুব একটা সাহস করছিল না এমন কঠিন এক চরিত্রে অভিনয় করতে। তাই তারা ভেবেছিল হয়তো নতুন নায়িকার খোঁজ করতে হবে। কিন্তু আলিয়া নিজেই সঞ্জয় লীলাকে ফোন করে জানান যে তিনি কাজ করতে আগ্রহী।

পুরোদমে নিজেকে চরিত্রর সাথে মিশিয়ে কাজ করেন আলিয়া। তার এই নতুন রূপ দেখার জন্য ভক্তরা বা পুরো বলিউড প্রস্তুত ছিল না। এবছর সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি। সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন সঞ্জয় লীলা বানসালি গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি ছবির জন্য। সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান আলিয়া ভাট। পুরস্কার পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন নিজের অনূভুতি । তিনি লেখেন, ‘যেদিন আমরা গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাড়ি ছবির শ্যুটিং শেষ করলাম আমার হাত কাঁপছিল। তখন আমার মন কান্নায় ভরে যায়। আমি আমার কলাকুশলীদের বলেছিলাম যে আমি জানি না ছবিটি হিট হবে না কি ফ্লপ হবে, তবে শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা আমি সব সময় মনে রাখব। এর থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। একই সাথে সঞ্জয় স্যারের নির্দেশনাও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং এ কারণেই ছবিটি ব্লকবাস্টার হয়েছে। আমি যখন সেই সেট থেকে বেরিয়ে এসেছি, তখন আমি অনুভব করেছি যে একজন ব্যক্তি হিসেবে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং এসব সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আমার এত ভালো টিম আছে বলে।’

সেই আবেগঘন পোস্ট নেট দুনিয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া আলিয়া ভাট হাইওয়ে, টু স্টেটস, আগলি, শানদার, উড়তা পাঞ্জাব, আয় দিল হ্যায় মুশকিল, ডিয়ার জেন্দগি, বন্দ্রীনাথ কি দুলহানিয়া, রাজি, জিরো, আংরেজি মিডিয়াম, রকি অর রানি কি প্রেম কাহানির মতো আরো অনেক সিনেমা করেন। তিনটি ফিল্মফেয়ার, আন্তর্জাতিক ভারতীয় চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমি পুরস্কার, জি সিনে পুরস্কার, স্ক্রিন পুরস্কারসহ ভাট এযাবৎ ৫২টি পুরস্কার এবং ৪৪টি মনোনয়ন পেয়েছেন।

এ তো গেল ক্যারিয়ার। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও রয়েছে সবার আগ্রহ। ১৪ এপ্রিল ২০২২ সালে সবার জল্পনা কল্পনা মিটিয়ে আলিয়া ভাট বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অভিনেতা রণবীর কাপুরের সাথে। প্রায় ৫ বছরের প্রেমের পরিণতি দেন তারা। আলিয়ার বিয়ের ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে আসার পর পরই তার বিয়ের পোশাক নজর কেড়ে নেয় সবার। বিয়ের কিছুদিন পরেই আলিয়ার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। খুশির জোয়ারে ভাসছিলেন গোটা কাপুর ও ভাট পরিবার।

ভক্তদের মতে বিয়ের ও সন্তান জন্ম দেওয়ার পর আলিয়া যেন আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছেন। তার কথাবার্তা হয়েছে আরো বেশি মার্জিত, এসেছে আরো বেশি পরিপক্কতা। তাই তো নতুন করে আলিয়া পেয়েছে সবার গ্রহণযোগ্যতা। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মাতৃত্ব আমার মধ্যে অনেক বদল নিয়ে এসেছে। এখনও এক মাস হয়নি। সবে তিন সপ্তাহ হয়েছে ও এসেছে, কিন্তু এর মধ্যেই আমি বুঝেছি যে আমার মধ্যে বদল এসেছে। আগামীতে কোন চরিত্রে অভিনয় করব সেটা আমাকে খুব ভেবে, বুঝে বাছতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি যেভাবে সব কিছু দেখতাম এতদিন সেটাতেই বদল এসেছে। আমার মন আরও বড় হয়েছে আগের তুলনায়। আমি জানি না এটার কারণে আগামীতে কোনো পরিবর্তন আসতে চলেছে।’ সব শেষে তিনি বলেন, আগামীতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা দেখার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তিনি দেখতে চান তার সফর এবার কোন দিকে বাঁক নেয়।

বরাবরই আলিয়া ভাট তার ফ্যাশন সেন্সের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আলিয়া হয়ে উঠেছেন ফ্যাশন আইকন। তিনি নিজেকে সব সময় ক্লাসি আউটফিটে রাখতে পছন্দ করেন, খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক বা সাজে তাকে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় তাকে দেখা যায় লিলেনের কাপড়ে, এতে বোঝা যায় তিনি ফ্যাশনের পাশাপাশি স্বস্তির বিষয়টি প্রাধান্য দেন। আলিয়া তার পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ, সানগ্লাস ও জুতার ব্যাপারেও খুব সচেতন। বাহারি বড় সানগ্লাসে তাকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। জুতার মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন স্নিকার্স। কারণ তিনি ডেনিমের ভক্ত আর স্নিকার্স ডেনিমের সাথে বেশ মানানসই। আলিয়া ভাটের সবচেয়ে বেশি পছন্দ ব্যাকপ্যাক। এমন তথ্য জানিয়েছেন নিজেই।

সম্প্রতি আলিয়া ভাট বিশ্বের নামকরা ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘গুচি’র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হন। প্রথম ভারতীয় অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেন গুচি। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে আয়োজিত হয় ‘গুচি ক্রুজ ২০২৪’। সেই ইভেন্টে আলিয়ার পরনে ছিল কালো কালো রঙের শর্ট ড্রেস, হাতে গুচি জ্যাকি ১৯৬১-র বিশেষ এডিশনেরর বিশেষ এডিশনের স্বচ্ছ ব্যাগ। যে ব্যাগের দাম ছিল প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।

একের পর এক সাফল্য, পরিবার ও কন্যাকে নিয়ে আলিয়া ভাট যে বেশ আছেন তা যে কেউ বলে দিতে পারবে। কিন্তু তারকা বলে কথা। সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ঠিক রাখতে হয় নিজের ফিটনেস। তার প্রথম সিনেমা ‘স্টুডেন্ট অফ দ্যা ইয়ারে’ কাজ করার আগে তার ওজন ছিল ৯০ কেজি। সিনেমায় কাজ করার সুযোগ পাওয়ার পর কাঠ কয়লা পুড়িয়ে নিজের ওজন কমিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু মা হবার পর অন্য সব মেয়েদের মতো স্বাভাবিকভাবে তার আসে শারীরিক পরিবর্তন। বেশ মুটিয়ে যান তিনি। আবার সেই বাড়তি ওজন কমিয়েও ফেলেছেন কিছুদিনের মধ্যেই। তার ফিটনেস ও ওজন কমানোর বিষয়ে বেশ খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তিনি জানান, মেয়ে জন্ম দেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই জিমে জয়েন করেন।

তিনি মায়েদের বলেছেন, ‘ডেলিভারি হওয়ার পর প্রথমেই নিজের শরীরের কথা শুনবেন। এমন কোনও জিনিস করবেন না যাতে আপনার শরীর সঙ্গ দেবে না। প্রথম কিছু দিন আমি শুধু শ্বাস নিয়েছি, হেঁটেছি। এখন নিজের শরীরে পুরনো ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি।’ তিনি জানান, ঘুম থেকে উঠেই তার পছন্দের খাবার হচ্ছে হারবাল চা। এছাড়া তিনি প্রচুর পানি ও ফলের রস পান করে থাকেন। তিনি রোজ ওজন মাপেন না। কারণ ওজনের উঠানামা তাকে আরো হতাশ করে দিবে। তাই সপ্তাহে একদিন নিজের ওজন পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট বলে মনে করেন তিনি। দুপুরে খাবারের তালিকায় আলিয়া রেখে থাকেন একটি ঘি ছাড়া রুটি, সঙ্গে সিদ্ধ সবজি, এক কাপ ডাল, সঙ্গে দই বা চিকেন। সন্ধ্যেবেলায় চিনি ছাড়া চা বা কফি, সঙ্গে আবারও ইডলি সাম্বার। ডিনারে বা রাতের মেনুতে থাকে একটি রুটি, সবজি সঙ্গে ডাল ও একটি গ্রিল চিকেন।

মেকআপ ছাড়াও আলিয়ার গ্লো করা স্কিন বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। তিনি ভ্যানিটিতে ট্রাভেলিং স্কিনকেয়ার কিট রাখেন সবসময়। তিনি ঘর থেকে বের হবার সময় সানস্ক্রিন লাগান। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, মুখে যা-ই লাগান না-কেন, তা অবশ্যই হাত ও ঘাড়ে লাগানো উচিত। নিজের সৌন্দর্যের রহস্য জানতে চাইলে বলেন, নিজেকে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখতে হবে। তার জন্য ঘুম ও খাবারের রুটিন ঠিক রাখতে হবে, পাশাপাশি চাই রোজ ইয়োগা। যা মন ও শরীর দুটোকেই শান্ত করে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − 6 =