একজন ফারিয়া নেওয়াজ

নাহিন আশরাফ

কখনো ফেসবুক লাইভে, কখনো স্ট্যাটাসে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছেন ফারিয়া নেওয়াজ। অসম্ভব হাসিখুশি মানুষটা এখন সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ। তাকে নিয়ে হয় ইতিবাচক আলোচনা। কারো কথা কানে না নিয়ে নিজের মতো করে আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন নানা মাধ্যমে। নিজের হাতে সামলাচ্ছেন ব্যবসা। ফারিয়া নেওয়াজের লাইফস্টাইল স্টোর এসএ কর্পোরেশন অর্জন করেছে অনেক মানুষের বিশ্বাস। এটি অবশ্য একদিনে হয়নি, হাঁটি হাঁটি পা করে এগিয়ে গেছে প্রতিদিন।

যাত্রার শুরুটা অবশ্য অনেক আগে। ফারিয়া নেওয়াজকে চিনেন কিন্তু তার স্বামী আকিব আহনাফে চিনেন না তা হতে পারে না। খুব অল্প বয়সে আকিব আহনাফকে সাথে নিয়েই শুরু হয়েছিল তার গল্প। তখন অবশ্য আকিব আহনাফ ছিল তার প্রেমিক। সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, দুজনের হাতেই অবসর সময়। তখন থেকেই ভাবছিল কী করা যায়, যাতে সময় কাটবে আবার নিজের পায়েও দাঁড়ানো যাবে। ফারিয়া নেওয়াজের ছোটবেলা থেকেই সাজগোজের প্রতি আগ্রহ ছিল, যার ফলে মেকআপ সম্পর্কে তার ছিল অনেক ধারনা। তখন ভাবেন আসল মেকআপ প্রোডাক্ট সবার হাতে পৌঁছে দিবেন অনলাইনের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে তার প্রেমিক আকিব আহনাফ তাকে অনেক উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছিলেন বরাবর। যখন তিনি অনলাইন ব্যবসা শুরু করেন তখন খুব কম মানুষই অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছিল। মানুষ তখনও পুরোপুরি অনলাইন মাধ্যম বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি।

প্রথম দিকে সবার কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে সময় লাগলেও নিজের যোগ্যতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন। অনলাইনে অনেক সাড়া পাওয়ার পর ফারিয়া নেওয়াজ স্টোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যেহেতু স্টোরে অনেক ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার রয়েছে তাই তারা একটু চিন্তায় ছিলেন যে কতটুকু সফলতা আসবে। প্রথমে একটা স্টোরের ৫০% ভাগ নেওয়ার কথা ভাবলেও পরবর্তীতে তারা পুরো একটা স্টোরই নিজেদের জন্য নিয়ে নেন। স্টোরের ওপেনিংয়ের দিন মানুষের এতো সাড়া পাওয়া যাবে তারা কল্পনাও করেননি। তখন ফারিয়া নেওয়াজ অনেক সাহস ও নিজের উপর বিশ্বাস পান যে তিনি চেষ্টা করলেই পারবেন সফল হতে। তাদের প্রথম আউটলেট ছিল গুলশানের পুলিশ প্লাজাতে। আউটলেট একটু ছোট হবার কারণে সবার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে মেকআপ কিনতে হতো। এই অবস্থা দেখে একে একে মিরপুর ও ধানমন্ডিতে আরো দুটি আউটলেট চালু হয়। শুরুর দিকে ফারিয়াকে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে স্টোরে গিয়ে বেচা কেনা করতো এবং তার স্বামী ক্যাশ সেকশনে বসতেন। এইভাবে প্রায় একবছর চলার পর স্টোরের জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। মেকআপ প্রোডাক্ট দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে স্টোরে জামা, জুতা, জুয়েলারি, ঘড়ি, ব্যাগ, পারফিউমসহ সকল নিত্যদিনের ব্যবহারের জিনিস বিক্রি হয়। সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো পণ্য দেওয়ার জন্য চারপাশে ফারিয়া নেওয়াজের বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ে।

কীভাবে এতো অল্প বয়স থেকে গুছিয়ে ব্যবসা করছেন জানতে চাইলে ফারিয়া বলেন, তার পরিবারের বেশিভাগ মানুষই ব্যবসা করেন। তিনি কাউকে চাকরি করতে দেখেননি। তার মা একসময় বাচ্চাদের কাপড় বানিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে সাপ্লাই দিতেন। তাই তিনি ব্যবসা করার ব্যাপারটা অনেকটা পরিবার থেকেই পেয়েছেন। আর তাছাড়া মেকআপের প্রতি টান ছিল। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ব্যবসা ছাড়া আর অন্য কিছু করার কথা ভাবতে পারেননি। আর শুরু থেকেই তার পরিবার তাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। পরিবার থেকে বলা ছিল, লেখাপড়া ঠিক রেখে তিনি সব কিছুই করতে পারবেন। ফারিয়া মনে করেন, জীবনের সবকিছুতেই পরিবার পাশে থাকলে সব সহজ হয়ে যায়। ব্যবসা একা হাতে সামলানোর সময় তার প্রচুর চাপ নিতে হতো। সেইসব চাপ থেকে উঠে দাঁড়াতেও তার পরিবার তাকে সাহায্য করত। তাই তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন।

ব্যবসা ছাড়াও ফারিয়া আরো নানা কারণে সবার মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে তিনি লাইভ করেন ও তার জীবন নিয়ে ডেইলি ব্লগ করেন। যা পোস্ট করার পর অনেকেই অনেক খারাপ মন্তব্য করেন যার জবাব তিনি খুব মজার ছলে দিয়ে থাকেন। তা নিমিষেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। সবাই তার এই শিশুসুলভ আচরণ ও পাগলামি খুব উপভোগ করেন। হাসিখুশি ও ইতিবাচক মানসিকতার জন্য তিনি অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার নাম। ফারিয়া বলেন, তিনি কাজ করতে ভালোবাসেন ও পরিশ্রম করে তিনি কখনো হাঁপিয়ে যান না। তার একটি বড় কারণ হলো তিনি তার শখের কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কাজকে ভালোবাসলেই সেই কাজ সফলভাবে করা যাবে ও ক্লান্তি আসবে না। ফারিয়া নেওয়াজ ব্যবসা ছাড়াও ব্র্যান্ড প্রমোটি করছেন। অনেক নতুন উদ্যেক্তাদের তিনি প্রমোট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন।

কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ফারিয়া নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ও ভালোবাসেন। তিনি বরাবরই নিজের কাজকে শ্রদ্ধা করেন কারণ তার প্রতিষ্ঠানে অনেকেই তার উপর নির্ভরশীল। অনেকের রোজগার নির্ভর করছে তার উপর। তার মাথার উপর রয়েছে অনেকের দায়িত্ব। তাই সবার কথা চিন্তা করেই তিনি নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করে যেতে চান।

ফারিয়া নেওয়াজ নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই ভালোবাসেন, তিনি কখনোই কারো জীবনে হস্তক্ষেপ করতে ও সমালোচনা করতে পছন্দ করেন না। ফারিয়া খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ, অবসর পেলে তিনি তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ও সবার সাথে আনন্দ করতে খুব ভালোবাসেন। ফারিয়া বরাবর সবার সাথে একসাথে মিলেমিশে কাজ করাতে বিশ্বাসী। ভালোবাসেন ঘুরতে। তাই তো সুযোগ পেলেই চলে যান নতুন কোনো দেশে। ব্যবসার প্রয়োজনেও প্রচুর দেশে যেতে হয়, গিয়ে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতে হয় ক্রেতাদের জন্য সঠিক পণ্য।

ফারিয়া নেওয়াজের স্বামী আকিব আহনাফ শুরু থেকেই ছিলেন তার পাশে। দুজনে একসাথেই গড়ে তোলে আজকের ‘এসএ কর্পোরেশন’। ফারিয়া ও আকিব দুজনের পরিশ্রম ও স্বপ্নের জায়গা এটি। এসএ কর্পোরেশন নিয়ে রয়েছে তাদের অনেক আশা। ঢাকা শহরে এখন তাদের বেশ কয়েকটি আউটলেট থাকলেও তারা ছড়িয়ে যেতে চান পুরো দেশে। সবার ভালোবাসা নিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান।

জীবনে যখনি খারাপ সময় এসেছে কীভাবে সামলে নিয়েছেন জানতে চাইলে ফারিয়া বলেন, ‘জীবনে যাই হোক আমি সব সময় পজিটিভ থাকি ও হাসি মুখে থাকি। সবসময় পজিটিভ চিন্তাই আমার হাসিখুশি থাকার সবচেয়ে বড় রহস্য। জীবনকে ভালোবাসতে হবে! আমি আমার জীবনের প্রতিটা দিনই উপভোগ করি।’

ব্যবসায় যে নারী, পুরুষ, বয়স কোনোটাই বাধার কারণ হতে পারে না, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন ফারিয়া নেওয়াজ। তার সবার সাথে মিশে যাওয়ার গুণের কারণে সবাই তাকে খুব সাদরে গ্রহণ করেছেন। অনেকেই আছে যাদের মন ভালো না বা বিষণ্ন সময় কাটছে তারা বসে বসে ফারিয়া লাইভ কিংবা ব্লগ দেখছেন। সেটা দেখার ফলে তারা খুব ইতিবাচক এনার্জি পাচ্ছেন। কোনো সমালোচনা ও কটুক্তিকে তিনি গায়ে মাখান না, বরং তাদের নিজের মতো জবাব দিয়ে হাসতে হাসতে তা ভুলে যান। তাই অনেকেই তাকে নিজের জীবনের আদর্শ মনে করেন। ব্যবসায়ী ফারিয়া ছাড়াও ব্যক্তি ফারিয়ার প্রতি সবার রয়েছে বিশেষ টান। তার কথার ধরন ও মিশুক স্বভাব সকলকে আপন করে নিয়েছেন। তার স্টোরের স্টাফ থেকে শুরু করে আশেপাশে সবার সাথে তার খুব আন্তরিক সম্পর্ক। অনেকেই ভাসতে চান স্রোতের বিপরীতে। চাকরি না করে চান নিজের কিছু তৈরি করতে করতে, তারা সকলেই ফারিয়া নেওয়াজের কাছে থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three − two =