ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক বেঁচে আছেন

সকাল থেকে রাত নানা বিষয় নিয়ে খোঁজ করতে থাকি আমরা। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করি। ওয়েবসাইটের শুরুতেই www থাকে। ইন্টারনেটে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ব্যবহার করেনি এমন মানুষ পাওয়া বেশ দুষ্কর। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (সংক্ষিপ্ত রূপ দি ওয়েব) মূলত ইন্টারনেট দিয়ে দর্শনযোগ্য আন্তঃসংযোগকৃত তথ্যাদির একটি ভান্ডার। একটি ওয়েব ব্রাউজারের সহায়তা নিয়ে একজন দর্শক ওয়েবপৃষ্ঠা দেখতে পারে এবং সংযোগ বা হাইপারলিংক ব্যবহার করে নির্দেশনা গ্রহণ ও প্রদান করতে পারে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত হাইপার টেক্সট ডকুমেন্টগুলো নিয়ে কাজ করার প্রক্রিয়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব নামে পরিচিত। বিষয়টিকে সহজ করে বলার চেষ্টা করছি, ইন্টারনেট হলো একটি দীর্ঘ রাস্তা অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হলো রাস্তার পাশের বাড়িগুলো; যা একে অপরে রাস্তার সাথে সংযুক্ত। যেহেতু হাইপারলিংক সংযুক্ত থাকে তাই ওয়েব পৃষ্ঠা দেখা যায় যা টেক্সট, চিত্র, ভিডিও ও অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া যুক্ত করা যায়। তবে মনে রাখা জরুরি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কিন্তু ইন্টারনেট নয়, এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হলো ইন্টারনেটের একটি অংশ মাত্র। গত ১২ মার্চ ছিলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ৩৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।

এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের নেপথ্যে ছিলেন ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স লি। ১৯৫৫ সালের ৮ জুন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় একজন ব্রিটিশ পদার্থবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, এমআইটি অধ্যাপক এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক। তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কনসোর্টিয়ামের পরিচালক, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এখনো জীবিত রয়েছেন। ৬৮ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী ১৯৮৯ সালের মার্চে পূর্ববর্তী হাইপারটেক্সট সিস্টেম থেকে ধারণা নিয়ে যে প্রস্তাবনা লেখেন তা থেকেই উপত্তি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের। পরবর্তীতে তার সাথে যোগ দেন বেলজিয়ান বিজ্ঞানী রবার্ট কাইলিয়াউ। তারা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সার্নে কর্মরত ছিলেন। তবে এ আইডিয়াটি আরো আগে থেকেই টিমের মাথায় ঘুরছিল।

১৯৮০ সালে যখন সুইজারল্যান্ডে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে (ইউওএনআর) কাজ করতেন তখন বিভিন্ন জনের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে মাথা গরম হয়ে যেত। প্রায় একই ধরনের সমস্যা বা প্রশ্ন নিয়ে একেক সময় একেক জন আসত বা ফোন করত, আর একই উত্তর বারবার দিতে হতো। এর সমাধান কী, তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই মাথায় আইডিয়াটা আসে। এছাড়াও তিনি খেয়াল করেন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ আলাদা আলাদা কম্পিউটার সিস্টেম নিয়ে আসতো। আলাদা আলাদা কম্পিউটার সিস্টেম হওয়ার কারণে সকলে সম্বলিতভাবে কাজ করতে পারতো না। ওয়েবের উন্নতিসাধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি মার্কআপ ল্যাংগুয়েজ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন যার মাধ্যমে ওয়েব পৃষ্ঠা অলঙ্করণ বা কম্পোজ করা হয়।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব মূলত URL, HTTP এবং HTML এই তিনটি জিনিসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। Uniform Resource Locator হচ্ছে URL এর পূর্ণ রূপ। ওয়েব সাইটের ঠিকানাকেই URL বলে। সব ঠিকানাই ওয়েবে সংরক্ষিত থাকে। Hyper Text Transfer Protocol হচ্ছে HTTP এর পূর্ণ রূপ। এই প্রোটকলের সাহায্যে ওয়েবে কোন কোন মেসেজ ফরম্যাট এবং ট্রান্সমিট হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। এছাড়া ওয়েব সার্ভার আর ব্রাউজারের কাজও এই প্রোটকলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এটি ওয়েব পেইজের কাঠামো কি হবে তা ঠিক করে দিয়ে থাকে। এটি মূলত একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যার মাধ্যমে আমরা ওয়েব পেইজগুলোতে এক্সেস পাই। HTML হলো একটি বিশেষ ধরনের ভাষা। Hyper Text Markup Language এর সাহায্যে ওয়েব সাইট তৈরি করা হয়।

১৯৮৯ সালে টিম বার্নার্স লি এনকোয়ার সহ আরো বিশদ একটি তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রস্তাবনা করেন। রবার্ট কাইলিয়াউয়ের সহায়তায় ১৯৯০ সালের ১২ নভেম্বর তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আরো একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা প্রদান করেন। আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০০৪ সালে টিম বার্নাস লি’কে নাইটহুড প্রদান করেন। টিম বার্নাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন প্রায় সব পুরস্কারই পেয়েছেন। ডব্লিউডব্লিউডব্লিউয়ের হল অব ফেমে স্থান পাওয়া ছয়জনের একজন তিনি। তিনি ২০১৭ সালের কম্পিউটার বিজ্ঞানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুরিং পুরস্কার পেয়েছেন। এই পুরস্কারের সঙ্গে ছিল গুগলের সৌজন্যে ১০ লাখ ডলার। আরও যেসব পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তার মধ্যে আছে ‘টাইম’ সাময়িকীর দৃষ্টিতে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০০ ব্যক্তির একজন, ফিনল্যান্ডর মিলেনিয়াম প্রযুক্তি পুরস্কার, ওয়েব অ্যাওয়ার্ডের আজীবন সম্মাননা ইত্যাদি।

আজ থেকে তিন দশক আগে ওয়েবে কোনো রঙ ছিল না, ছবি ছিল না, ছিল না ভিডিও। বর্তমানে যেসব গ্রাফিক্স দেখতে পাই তার কিছুই ছিল না সেই ওয়েব পেইজে। ওই পেইজে যা ছিল তার সবই মূলত টেক্সট। সেই অবস্থা থেকে বর্তমানে ক্রমাগত পরিবর্তন ও সংস্করণের মাধ্যমে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। তখন উইন্ডোজ বা গুগল ক্রম ছিল না। ছিল না ওয়াইফাই বা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সিস্টেম। এমনকি ব্যক্তিগত কম্পিউটার খুঁজে পাওয়া বিরল ব্যাপারই ছিল। ইন্টারনেট শুধুমাত্র ই-মেল আদান প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হতো। তখন ইন্টারনেট সার্ফ করার সময় কানেক্ট হতো এনালগ টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে। ফলে লাইন পাওয়া ছিল বিরাট ধৈর্যের ব্যাপার। ১৯৮৯ সালে সেই ওরিজিনাল পেইজটাতে কোনো অ্যাড্রেস বার ছিল না। কোনো ছবি বা শব্দও ছিল না।

বর্তমানে আমরা ব্যবহার করছি ৪জি ও ৫জি’র মতো দ্রুতগামী ইন্টারনেট ব্যবস্থা। কিন্তু এরপরও সংযোগে আধা সেকেন্ড দেরি হলে আমরা অস্থির হয়ে উঠি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত তা অনেক বদলে গেছে, হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ বা এইচটিএমএল-এর দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বরে সিইআরএন এটিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে অগাস্ট মাসে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্য। ১৯৯৩ সালের ৩০ এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব সফটওয়্যারকে সিইআরএন পাবলিক ডোমেইনে রেখে দেয় এবং সহজে বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি ওপেন লাইসেন্স নিয়ে কাজ শুরু করার ব্যবস্থা রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে বর্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কনসোর্টিয়াম বা ডাব্লিউথ্রিসি সৃষ্টি করেন। এটিই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান।

যেহেতু সকলেই এই ওয়েব ব্যবহার করতে পারে তাই অপরাধীরাও বিভিন্ন ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য। এছাড়াও অনলাইন ক্যাসিনো, গুপ্তচরবৃত্তি, চোরাকারবারি থেকে শুরু করে হাজারো অপরাধ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ডার্ক ওয়েব, ডিপ ওয়েব-এর মতো ওয়েবসাইটের কথা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × five =