আফরোজা বেগম রীটা: কণার প্রথম দু’টো সন্তান ধাত্রীর হাতে বাসাতেই জন্মেছিল। প্রথমটি মেয়ে, দ্বিতীয়টি ছেলে। দিনমজুর স্বামী ও সে নিজেও কোনো লেখাপড়া জানেনা। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য যে জ্ঞান থাকা দরকার, তাও তাদের নেই। ফলে এবার আসছে তৃতীয় সন্তান। কণার বয়স মাত্র উনিশ বছর। স্বাস্থ্যহীন, অপুষ্টিতে জর্জরিত সন্তানসম্ভবা একজন নারী সে। প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা কী এসব সে জানে না। ধাত্রীই তার বিশ্বাস, ধাত্রীর কথায় অনুরক্ত হয়ে সে থাকতে চায়। অথচ সে যেখানে বসবাস করে, সেখান থেকে দূরে নয় কমিউনিটি ক্লিনিক। নয়টা মাস অপেক্ষা করার পর একদিন সন্ধ্যায় ঐ ধাত্রীর হাতেই প্রসব জটিলতার কারণে একটি ফুটফুটে মৃত কন্যা প্রসব করল কণা। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই কণার তৃতীয় সন্তান এল প্রাণহীন হয়ে। শোকে পাথর, নীরব, নিথর হয়ে বেঁচে রইল কণা।
এরকম ঘটনা আমাদের দেশে অহরহই ঘটে চলেছে। সারা দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগ নারীর সন্তান প্রসব হয় দাই ধাত্রীদের হাতে। এদের ৮৫ ভাগ মনে করেন গর্ভধারণ খুবই সাধারণ একটি বিষয়। পরিবারকে ছোট রাখার বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কম। সন্তান ধারণ করলে কোনো নারীর যে যত্ন-আত্তি প্রয়োজন, তা তারা জানেন না। তাদের ধারণা বাড়তি খাবার খেয়ে, বিশ্রামে থাকলে প্রসূতির গর্ভের বাচ্চা বড় হয়ে গেলে প্রসব হতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, অর্থনৈতিক অসংগতির কারণে তাদের কাছে পুষ্টিকর খাবার বহু দূরের স্বপ্ন। অথচ প্রাকৃতিক শাক সবজি থেকে যে পুষ্টি পাওয়া যায়, সেটাও তারা জানে না।
প্রচলিত কুসংস্কার থেকে নারী তথা শিশুর জীবনকে অর্থবহ করে তোলা এবং সারাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৮-২০০১ সাল মেয়াদে ১০,৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত হয়েছিল এবং প্রায় ৮,০০০টি ক্লিনিক চালু হয়েছিল। পরবর্তীতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে পুনরায় চালু করার লক্ষ্যে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ঐ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮,০০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করার লক্ষ্যমাত্রার আওতায় মার্চ ২০১৪ নাগাদ ১২,৫৩৭ টি ক্লিনিক চালু হয়। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা ১৩৮৮১টি।
কমিউনিটি সেবাদানকারী হিসেবে সারা বাংলাদেশে ১৩,৮০০ (প্রায়) জন কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডার কাজ করছে। একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী নির্দিষ্ট সময়ে যৌথভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করে থাকেন। সেবা গ্রহণকারী জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে যে কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবার একটি পরামর্শ কেন্দ্র যা জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় সুস্বাস্থ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রভাবকের কাজ করে। স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিষয়ে জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বাড়ানোসহ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হলে তারা যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে, এ লক্ষ্যে তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞানদান করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার আওতায়। সুসম পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে জ্ঞানদান ও তা গ্রহনে উৎসাহ দান করাসহ স্বল্পব্যয়ে স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, পায়খানা ও বিশুদ্ধ পানির ব্যাবহার নিশ্চিতকরণও এ প্রকল্পের আওতায়।
এ উদ্যোগ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের একটি। সনাতন কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামী যাতে নারীর ক্ষমতায়নকে খর্ব করতে না পারে, নারী ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশকে ত্বরান্বিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দ্বারা একটি বলিষ্ঠ জাতি গঠন করার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বাস্থ্যখাতকে ডিজিটাল করার পদক্ষেপ হিসেবে এই ক্লিনিকগুলোতে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট মডেম প্রদান করা হয়েছে। সিবিএইচসির দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬১ কোটি ৫০ লাখে, ক্লিনিক থেকে জরুরি এবং জটিল রোগী রেফারের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার, স্বভাবিক প্রসবের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৯টি, গর্ভবতী মায়ের প্রসব পূর্ববর্তী সেবা (এএনসি) ২৩ লাখ, ৮৬ হাজার ২০৪টি, প্রসব-পরবর্তী সেবা (পিএনসি) ৮ লাখ, ১১ হাজার ৬৬৩টি। তাই এর কার্যক্রম সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতার ব্যাপ্তি বাড়ানো আমাদের বর্তমান সময়ের অঙ্গীকার হওয়া অনস্বীকার্য।
কমিউনিটি ক্লিনিক তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। গ্রামীণ জনপদে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে এর স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থা। সকল জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, সন্তানসম্ভবা মায়েদের প্রসুতিসংক্রান্ত যাবতীয় সেবা নিশ্চিত করা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সেবা প্রদান করা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সেবা সম্পর্কে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পরিচালনা করা, মা ও শিশুর খাদ্য ও পুষ্টিজ্ঞান বিষয়ে সহায়তা প্রদান করা, ছোঁয়াচে রোগ বালাই থেকে দূরে থাকার বিষয়ে জ্ঞান দান করা, জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীদের উপজেলা ও জেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রেরণ করা, টিকা প্রদান কর্মসূচিসহ বিনামূল্যে ৩০ প্রকার ঔষধ সরবরাহের মাধ্যমে ১৮ ধরনের সেবা প্রদান করা। ইত্যাদি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় পরিচালিত হওয়ার কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধি পায়; কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবাগ্রহণ দরিদ্র, হতদরিদ্র, গর্ভবতী মা এবং শিশু, বৃদ্ধ, কিশোর/কিশোরীর জন্য একটি অনন্য সুযোগ; কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; নিজ এলাকায় ক্লিনিক স্থাপিত হওয়ায় গ্রামীণ জনগণ হাতের নাগালের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুবিধা পেয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।
দুর্গম, অনুন্নত ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক একটি অত্যন্ত যুগোপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগ। কমিউনিটি ক্লিনিকে মূলত প্রতিরোধমূলক, প্রতিষেধক চিকিৎসা, পরামর্শ প্রদানসহ রেফারাল সেবা দেওয়া হয়। এই ক্লিনিকগুলো গ্রামীণ এলাকায় নির্মিত হওয়ায় দরিদ্র লোকেদের কোনো যাতায়াত খরচ লাগে না। ফলে গ্রামীণ জনগণ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারছেন। এই প্রতিষ্ঠানটির আশু উন্নয়নে ও স্থায়ীত্ব রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির সাথে সাথে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের দূরদৃষ্টির ভিত্তিতে তৈরি নীতি, নির্দেশনা, কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো উদাহরণ সৃষ্টিকারী কর্মসূচির কৌশলগত প্রয়োগের মাধ্যমে নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের দ্রুত অগ্রগতি সাধনের জন্য যে সেবা দেওয়া হচ্ছে, তার ফলে বাংলাদেশসহ স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগামী ১০টি দেশের তালিকায় আমাদের বাংলাদেশ রয়েছে প্রথম স্থানে। এ নিশ্চয় আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। সরকারের এ সফলতার অংশীদার আমরা সবাই- এ গল্পও সকলের জানা প্রয়োজন।