কিভাবে হতে পারে ক্রিকেট সংস্কার

সালেক সুফী

দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সংস্কার ছোয়া লেগেছে জনপ্রিয় ক্রিকেট অঙ্গনেও।  দেড় যুগের গণতন্ত্র বিহীন পরিবেশে স্বৈরতন্ত্র ক্রিকেট অঙ্গনে জেঁকে বসায় বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। বিসিবির মত সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু পরিবর্তন করা হয়েছে। পলাতক বিসিবি সভাপতি পদত্যাগ করেছেন। অধিকাংশ দলদাস এবং সুবিধাভোগী পরিচালক গা ঢাকা দিয়ে আছে।  বিসিবির পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের সদস্য পদ বাতিল হবে। পরিচালক ক্রিকেট অপারেশন জালাল ইউনুস পদত্যাগ করেছেন। পরিচালক সাজ্জাদুল আলম ববিকে এনএসসি পরিবর্তন করেছে। প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক, প্ৰাক্তন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদকে বিসিবি প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এনএসসির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালক হয়েছে দেশবরেণ্য ক্রিকেট প্রশিক্ষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। পরিবর্তনের ছোয়া লাগার পর বাংলাদেশ জাতীয় দল সফরে শক্তিশালী পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টেস্ট জয় করেছে। ক্রিকেট সংস্কার, সর্বস্তরে পুনরায় গঠনের এখন মাহেন্দ্র সময়।

সোনালি প্রজন্মের একঝাঁক বিশ্বমানের ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তিনটি ফরম্যাটেই দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সীমিত সাফল্য পেয়েছে। পরিকল্পনাহীনতা, অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচার এবং দুর্নীতির কারণে গড়ে উঠেনি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ঘরোয়া ক্রিকেট মান বলতে কিছু নেই। প্রতিভা অন্নেষণ-বিকাশ নিশ্চিত করে মেধাসম্পন্ন ক্রিকেটারদের পাইপ লাইন গড়ে তোলার কোনো সুদূরপ্রসারী পথনকশা নাই। নিবেদিত সংগঠক, মেধাবী প্রমাণিত ক্রিকেট প্রশাসকদের বিসিবিতে আসার পথ রুদ্ধ করে একশ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বিসিবিকে চর দখল করে রেখেছে দীর্ঘ সময়।

কোটা পদ্ধতিতে জাতীয় দল নির্বাচন, কোচিং স্টাফ নির্বাচন এবং নিয়োগে বিশেষ গোষ্ঠীর দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যাবহার, স্থানীয় ক্রিকেটকে কুক্ষিগত করে কাউন্সিলারশীপ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিজেদের পছন্দের ক্লাবগুলোকে ম্যাচ ফিক্সিং, পক্ষপাতমূলক আম্পয়ারিং করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া এগুলো করে স্থানীয় ক্রিকেটকে বিষাক্ত করে রেখেছে সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একমাত্র টুর্নামেন্ট বিপিএল গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব হয়নি।

উপরের নানা সমস্যা সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ক্রিকেট ঘিরে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। এই পরিবর্তন হবে তিন স্তরে, প্রথমে পলিসি, দ্বিতীয় প্রাতিষ্ঠানিক, তৃতীয় অবকাঠামো।

প্রথমেই বিসিবি গঠনতন্ত্রকে ঢেলে সাজিয়ে এমন ভাবে যুগোপযোগী করে সাজাতে হবে যার ফলে সুযোগসন্ধানী মহল যাতে গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সিন্দাবাদের বুড়োর মত ক্রিকেটের ঘাড়ে চড়ে বসে রক্ত চুষতে না পারে।  সারা দেশে অন্তত ১০-১২ কেন্দ্রে যেন ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশ থেকে দক্ষ, নিবেদিত ক্রিকেট সংগঠকরা যেন জেলা পর্যায় বিভাগীয় পর্যায় থেকে কেন্দ্রে উঠে আসতে পারে। নির্বাচনের প্রক্রিয়াও যেন স্বচ্ছ হয়। গঠনতন্ত্র সংস্কার করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করা হলে সত্যিকার যোগ্য, দক্ষ ক্রিকেটমনস্ক ব্যাক্তিত্ব বিসিবিতে আসার সুযোগ পাবে।

ঢেলে সাজাতে হবে ক্রিকেট অবকাঠামো। ক্রিকেটকে শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে সীমিত না রেখে বিভাগীয় সদর দপ্তর সহ কুমিল্লা, ফরিদপুর, যশোর, কক্সবাজার, রাঙামাটি, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, পাবনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি স্থানে উন্নত মানের উইকেট সহ খেলার মাঠ, ইনডোর অনুশীলন ফেসিলিটি গড়ে তুলতে হবে। বিপিএল আসর হোম এন্ড আওয়ে ভিত্তিতে করে বিপিএলকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এনসিএল, বিসিএলের পাশাপাশি আরো একটি চার দিন ব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট করা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। একই সঙ্গে এক সময় ঢাকার বাইরে চালু থাকা টুর্নামেন্ট গুলো আবারো অনুষ্ঠান করার জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। বিভাগীয় ক্রিকেট সংগঠক সক্রিয় করতে হবে। অন্তত ৩-৪টি ক্রিকেট একাডেমিকে সক্রিয় করতে হবে।

খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, নির্বাচকমন্ডলী, বিসিবি কর্মকর্তাদের কোড অফ কন্ডাক্ট নির্ধারণ করে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করতে হবে। কোন খেলোয়াড় সক্রিয় থাকা অবস্থায় রাজনীতি করতে পারবে না। বিজ্ঞাপন মডেল হওয়ার বিষয়েও নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে। হেড কোচ এবং কোচিং স্টাফ নির্বাচন পদ্ধতি স্বচ্ছ এবং জবাদিহিমূলক হতে হবে।

আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পনের আগেই ক্রিকেটে মৌলিক সংস্কার গুলো করতে পারবে। দেশে এবং প্রবাসে অনেক প্রাক্তন প্রমাণিত দক্ষ ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব আছেন। সরকার উদ্যোগী হয়ে অংশীদারদের সম্পৃক্ত করে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার কাজ  কাজ শুরু করতে পারে।

দেশে তৃণমুল পর্যন্ত ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আছে। এই উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা পরাশক্তি। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে আফগানিস্তান। সঠিকভাবে সংস্কার করে পরিকল্পিত পথে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ ৩-৫ বছরে ক্রিকেটে পরাশক্তি হয়ে উঠবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × three =