কুড়িগ্রামের এক অসামান্য মা লুৎফা

শবনম শিউলি

একজন মা কি পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে একজন মা কী না পারেন? সন্তানের জন্য মা যেকোনো কিছুই করতে পারেন। এটা পৃথিবীর সব মায়েদের জন্যই প্রযোজ্য। সন্তানকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে এই পৃথিবীতে আসার পর মায়ের মৃত্যু কিংবা সন্তানের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন মা তার সর্বস্ব দিয়ে তার সন্তানকে ধরে রাখেন। একজন মা সন্তানকে যা দেন, তাই সন্তানের জন্য আদর্শ। সন্তানের জন্য মা নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেওয়া এক অনন্য মানুষ হলেন মা। লুৎফা তেমনই একজন মা। যিনি তার সন্তানের জন্য সব করতে পারেন। সন্তান তাকে কি দেবে না দেবে তা তার জন্য কোনো অর্থই বহন করে না। লুৎফা এমন একজন মা যিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন আরও দশজন মায়ের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন। যার কাজ আজ বিশ্ববাসী জানেন।

প্রতি বছর বিবিসি প্রভাবশালী নারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যেখানে বিশ্ববাসী পরিচিত হন অনন্য কিছু মানুষের সঙ্গে। যারা তাদের কমিউনিটি, দেশ কিংবা গোটা পৃথিবীর জন্য আদর্শ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করেন। বিবিসি এমন নারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় পুরো বিশ্বকে। সেই তালিকায় প্রতিবারেই বাংলাদেশি এক বা একাধিক নারী স্থান করে নেন। ২০২৪ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবার বিবিসির প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন রিক্তা আখতার বানু লুৎফা। যিনি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার বাসিন্দা। স্বল্পশিক্ষিত এই নারী নিজের সন্তানের কথা চিন্তা করে এমন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন যা প্রমাণ করে একজন মা কি না করতে পারেন।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে চিলমারী জনপদ। নদীর মানুষ যাদের বলা হয়। যারা প্রতি বছর দেখেন নদী ভাঙ্গনের ভয়াবহতা। এর পরেও তারা লড়াই করে বাঁচেন। তাই লড়াই করা যেন তাদের চারিত্রিক এক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে। তবে এই জনপদ এখনও অন্ধকার কিছু কুসংস্কার থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে আসতে পারেনি। যেমন প্রতিবন্ধত্ব বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষগুলোকে তারা এখনও স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেন না। তারা এখনও তাদের জীবনে অভিশাপের মতো। সেই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ লুৎফা। তার সন্তান স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বৈষম্যের শিকার হয়। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত তার কন্যা সন্তানকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই কষ্ট লুৎফাকে ঘুমাতে দেয়নি অনেক বছর। এই কষ্ট শুধু লুৎফার ছিল না। চিলমারীর অনেক ঘরেই এমন মায়েরা ছিলেন যারা এই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।

২০০৯ সালে তিনি নিজের জমি বিক্রি করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যে স্কুলের নাম দেন রিক্তা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। রিক্তার লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি স্কুলে এখন তিনশর বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এ স্কুলটি প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। স্কুলটি প্রাথমিকভাবে অটিস্টিক বা শেখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেটি বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধতা থাকা শিশু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করিয়ে থাকে।

পেশাগত জীবনে চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স রিক্তা। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের দক্ষিণ ধনঞ্জয় গ্রামের মৃত নুর মোহাম্মদের কন্যা তিনি। স্বামীর বাড়ি চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের রমনা সরকার পাড়া গ্রামে। বর্তমানে স্বামী-সন্তান নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন তিনি। তার স্বামীর নাম আবু তারিক আলম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের একশ গুরুত্বপূর্ণ নারীর সঙ্গে নিজের নাম থাকায় আনন্দিত রিক্তা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের কারণে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের তালিকায় আমাকে স্থান দিয়ে সম্মানিত করেছে বিবিসি। আমি আপ্লুত। এই কৃতিত্ব আমার একার নয়। বিবিসি পরিবার এবং আমার জেলার সংবাদকর্মীসহ আমার কাজে উৎসাহ দেওয়া সকলের।’

জলবায়ু কর্মী, সংস্কৃতি ও শিক্ষা, বিনোদন ও ক্রীড়া, রাজনীতি ও অ্যাডভোকেসি এবং বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি এই পাঁচটি বিভাগে ১০০ জন নারীকে তালিকায় জায়গা দেওয়া হয় প্রতি বছর। সেখানে স্থান পেয়েছেন রিক্তা আখতার বানু। বিবিসির এই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের এমন সব নারীকে জায়গা দেওয়া হয় যারা কঠিন পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এই তালিকায় আছেন ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, স্পেনসহ অনেক দেশের নারীরা। তাদের মধ্যে আছেন মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়ামস, ধর্ষণের শিকার গিসেল পেলিকট, অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, অলিম্পিক অ্যাথলিট রেবেকা আন্দ্রাদে এবং অ্যালিসন ফিলিক্স, গায়িকা রয়ে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ঘধফরধ গঁৎধফ, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ট্রেসি এমিন, জলবায়ু আন্দোলনকর্মী অ্যাডেনিকি ওলাদোসু এবং লেখক ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীনের মতো প্রভাবশালী নারীদের পাশাপাশি এমন দেশগুলোর নারীরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন সুযোগ না থাকলেও কিভাবে লড়ে যেতে হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হয়েও তারা লড়ে যাচ্ছেন নিজের দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য। গাজা, লেবানন, ইউক্রেন এবং সুদানে সংঘাত এবং মানবিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনের পর সমাজে যে বিভাজন দেখা দিয়েছে, সেসব কিছুর মাঝে নারীদের নতুন মাত্রার সহনশীলতা এবং সংকটের মোকাবেলা করতে হয়েছে।

বাধা পেরিয়ে চার ফিলিস্তিনি নারী

এবারের তালিকায় আছেন ফিলিস্তিনের চার নারী। তাদের মধ্যে একজন হলেন এনাস আল-ঘুল, যিনি একজন কৃষি প্রকৌশলী। গাজায় যুদ্ধের কারণে যখন পানি সংকট সৃষ্টি হয়, এনাস আল-ঘুল ভাবলেন তাকে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কৃষি প্রকৌশলী এনাস আল-ঘুল পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন উপকরণ যেমন কাঠ, কাচ এবং তাপালিন ব্যবহার করে একটি সোলার-পাওয়ারড ডেসালিনেশন ডিভাইস তৈরি করেন। যেটি সাগরের পানি পানযোগ্য করে তুলতে সক্ষম। এই ডিভাইসটি বর্তমানে গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকার তাঁবুতে বসবাসকারী অনেক মানুষের জন্য জীবনরক্ষার একটি উপকরণ হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের কারণে পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। পালানো প্যালেস্টিনীয়দের সাহায্য করতে আল-ঘুল আরও একটি সোলার-পাওয়ারড কুকার তৈরি করেছেন। এদিকে, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ শিরীন আবেদ ইসরায়েলি বিমান হামলা সত্ত্বেও গাজায় নবজাতকদের যত্ন নেওয়া থেকে বিরত থাকেননি। তিনি বর্তমানে আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের মাতৃত্বকেন্দ্রের পরিচালক। তিনি এমন জরুরি ব্যবস্থা চালু করেন, যাতে চিকিৎসকরা সীমিত সম্পদ দিয়ে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা দিতে পারেন। সিরিয়ার আরও একজন তালিকাভুক্ত নারী হলেন ফ্যাশন ডিজাইনার ইয়াসমিন মজল্লি। মজল্লি তার পোশাককে ব্যবহার করেছেন প্যালেস্টিনীয়দের গল্প বলার জন্য। এছাড়া তিনি বিশ্বব্যাপী নারীদের ওপর সড়কে হয়রানির বিষয়েও বক্তব্য দিয়েছেন। ডেনিম জ্যাকেট এবং টি-শার্টে ‘নট ইয়োর হাবিবতি’ (তোমার বাচ্চা না) শব্দগুলো লেখেন। সাংবাদিক এবং লেখক প্লেস্তিয়া আলাকাদও এই তালিকাভুক্ত একজন নারী। বাইশ বছর বয়সী প্লেস্তিয়া আলাকাদ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। এ সময় গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে, তিনি ইসরায়েলি বিমান হামলার মধ্যে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে গাজা আপডেট, কবিতা এবং ডায়েরি পোস্টের মাধ্যমে ইনস্টাগ্রামে তার ফলোয়ার চার মিলিয়ন হয়ে যায়। তার স্মৃতিচারণমূলক বই ‘আইজ অফ গাজা’ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। আলাকাদ ২০২৪ সালের ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ডের সাংবাদিক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বের কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলনের মতো উঁচু পর্যায়ের ফোরামে প্যালেস্টিনীয়দের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন।

তালিকার আফগান নারীরা

আফগান গায়িকা ও সুরকার এলাহা সোরুর আফগানিস্তানের নারীদের কণ্ঠস্বর জনজীবন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে এবং উৎসাহ দিতে ‘নান, কার, আজাদি!’ (রুটি, কাজ, স্বাধীনতা!) শিরোনামে একটি সঙ্গীত রচনা করেন। এছাড়া তালিকায় আরও আছেন মিডিয়া এবং শিক্ষা উদ্যোক্তা হামিদা আমান। আরও আছেন ট্যাকওন্ডো প্যারালিম্পিয়ান জাকিয়া খুদাদাদি। যিনি প্যারালিম্পিক শরণার্থী দলের প্রথম সদস্য হিসেবে পদক জিতে ২০২৪ প্যারিস গেমসে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − two =