কেমন হচ্ছে শান্ত-জ্যোতিদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি

নিবিড় চৌধুরী

ব্যাটাররা রান পাচ্ছেন না, বোলাররা উইকেট নিতে ভুলে গেছেন, সহজ ক্যাচ ফিল্ডারদের হাত ফসকে যাচ্ছে, হঠাৎ এমন ফর্মহীনতা আসতে পারে যেকোনো দলে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে এমনটা যদি হয় তবে বিসিবি কী করে? খুব সহজ উত্তর, মিরপুরে হোক বা হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ খেলে। নতুন শতকের শুরু থেকে তো এমনটাই হয়ে আসছে! বলতে গেলে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু জিম্বাবুয়ে। একসময় দুই দলের সিরিজ মানে ছিল সমানে সমানে ঠেক্কা। কিন্তু সময় পাল্টেছে। বাংলাদেশ এখন বেশ এগিয়ে গেছে জিম্বাবুয়েনদের থেকে। বিশেষ করে একদিনের ক্রিকেটে। এক সময় এগিয়ে থাকা জিম্বাবুয়েনরা যেন এখন ‘ঢাল-তলোয়ারহীন’। এবার তারা আরেকটি বিশ্বকাপও দেখবে দর্শক হয়ে।

বাছাইপর্বের সাঁকো পেরোতে না পারায় জুনে যুক্তরাষ্ট্র-ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলা হবে না জিম্বাবুয়ের। তবে বাংলাদেশকে ফর্মে ফেরাতে এপ্রিলেই ঢাকায় চলে আসছেন সিকান্দার রাজারা। বিশ্বকাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে খেলবে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। ৩ মে চট্টগ্রামে শুরু সিরিজের প্রথম ম্যাচ। ১২ মে মিরপুরে শেষ টি-টোয়েন্টি।

নাজমুল হোসেন শান্তদের প্রস্তুতি এখানেই শেষ হচ্ছে না। মূল লড়াইয়ে নামার আগে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তাদের মাটিতেও ২১, ২৩ ও ২৫ মে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ খেলতে হোক বা এই সিরিজ, এটিই বাংলাদেশ দলের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর হতে যাচ্ছে। তবে ক্রিকেটে মার্কিনীরা এখন ‘অ্যামেচার’ পর্যায়ে নেই। তাই তাদের হালকাভাবে নেওয়ারও সুযোগ নেই। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ভারত, পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিজেদের দলে নিয়েছে। এমনকি নিউ জিল্যান্ডের সাবেক ব্যাটিং অলরাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসনও খেলবেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে।

বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ নিজেদের শেষবারের মতোন ঝালিয়ে নিতে দুই দলের বিপক্ষে আটটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে। এটাও কম নয়। কিন্তু একই কারণে বড় দলগুলো যখন বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সারবে সেখানে বাংলাদেশকে খেলতে হচ্ছে দুটি ‘কমজোর’ দলের বিপক্ষে। পাকিস্তানের কথাই ধরুন। বাবর আজমরা বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে প্রাথমিক দল নিয়ে আর্মি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঘরের মাটিতে নিউ জিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে খেলেছে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। ভারত তো আইপিএল দিয়েই এক প্রকার প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছে।

২০২৪ হতে যাচ্ছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে খেলবে ২০ দল। ‘ডি’ গ্রুপে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ মিশন শুরু করবে ৮ জুন, টেক্সাসে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। লঙ্কানদের বিপক্ষে ভারতে গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের ‘টাইমড আউট’ নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন সাকিব আল হাসানরা। শ্রীলঙ্কা গত মার্চে বাংলাদেশ সফর করে গেছে। ওয়ানডে সিরিজ হারলেও জিতেছে টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট সিরিজ। বিশ্বকাপের আগে দুই সিরিজ জয়ে একটি বার্তাও দিয়ে রাখল তারাÑছেড়ে কথা বলবে না।

বিশ্বকাপের জন্য প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলা ছাড়াও কেমন প্রস্তুতি নিচ্ছেন শান্তরা? বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ফিটনেস নিয়ে ফিসফাস বেশ আগে থেকে। তবে এবার খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছে বিসিবি। গত ২০ এপ্রিল সকালে জাতীয় দল ও আশপাশে থাকা ৩৪ ক্রিকেটার ফিটনেস টেস্ট দিয়েছেন দেশের অনেক ক্রিকেটের অসংখ্য সোনালি সময়ের সাক্ষী বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকে। এবারের ফিটনেস টেস্টে একটু ব্যতিক্রম ছিল। ট্র্যাকে মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা দৌড়ালেন টানা চার চক্করে ১৬০০ মিটার। ৩৪ ক্রিকেটারের ১৭ জন করে দুই দল ভাগ হয়ে রানিং পরীক্ষা দিয়েছেন। ফিটনেসের পুরো প্রক্রিয়াটি তদারকি করছেন বিসিবির নতুন কন্ডিশনিং কোচ ও ট্রেইনার নাথান কেইলি। তার সঙ্গে ছিলেন অন্য ট্রেইনাররাও।

ফিজিক্যাল পারফরম্যান্স মূল্যায়নের অংশ হিসেবে রানিং পরীক্ষা হয়েছে দুই ধাপে। প্রথম হয়েছেন দুই পেসার। প্রথম ধাপের দৌড়ে সবচেয়ে কম সময় নেন ২১ বছর বয়সী পেসার তানজিম হাসান সাকিব। সবচেয়ে বেশি সময় নেন ৩৮ বছর বয়সী অলরাউন্ডার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দ্বিতীয় ধাপের দৌড়ে প্রথম হয়েছেন বাংলাদেশ দলের ২১ বছর বয়সী আরেক নতুন পেসার নাহিদ রানা। সবার শেষে দৌড় শেষ করেছেন ২৩ বছরের ব্যাটার শামীম হোসেন পাটোয়ারি। দুই ধাপ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়েছেন তিনিই। তবে বাকিদের ভেতরে বেশ চনমনে ভাবই লক্ষ্য করা গেছে। যথেষ্ট ভালো করেছেন তারা।

৩৯ ক্রিকেটার টেস্ট দেওয়ার কথা থাকলেও ফিটনেস পরীক্ষায় ছিলেন না পাঁচ ক্রিকেটার। সাকিব আল হাসান দেশের বাইরে, আইপিএল খেলতে মোস্তাফিজুর রহমান ভারতে, চোটের কারণে সৌম্য সরকার ও তাইজুল ইসলাম আর ব্যক্তিগত কারণে তাসকিন আহমেদ ছুটিতে থাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তাদের দেখা যায়নি।

ফিটনেস পরীক্ষার আগে নতুন কোচও পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানের সাবেক স্পিন কিংবদন্তি মুশতাক আহমেদকে স্পিন কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বিসিবি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান-মেহেদী হাসান মিরাজদের সঙ্গে কাজ করবেন তিনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজই তার প্রথম অ্যাসাইমেন্ট। এই সিরিজকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে ২৩ দলের প্রাথমিক দল দিয়েছে বিসিবি। তবে সেই দলে নেই সাকিব। অবশ্য এই নয় যে, তিনি সিরিজ খেলবেন না। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে দেখা যেতে পারে সিরিজের শেষ দুটি ম্যাচে। অর্থাৎ, চট্টগ্রাম পর্বে না খেললেও থাকবেন ঢাকা পর্বে। বিসিবির টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে এমনটাই কথা হয়েছে তার। এমনকি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) শেষ কয়েকটি ম্যাচে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়েও দেখা যাবে সাকিবকে।

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির আরেক মঞ্চ ভাবা যেতে পারে ডিপিএলকে। সেখানে জিম্বাবুয়ে সিরিজে থাকা পারভেজ হোসেন ইমন বেশ ভালো রান করেছেন। জাতীয় দলের অনেকে যোগ দিয়েছেন লিগের মাঝপর্যায়ে। তবে লিগটা যেহেতু ৫০ ওভারের সেটা দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সারা যাবে না। কারণ, অনেকে ধারনা করেছেন এবারের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে রানবন্যার। ১৭তম আইপিএলে যেভাবে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ও রানবন্যা হচ্ছে, তাতে অনুমান করায় যায়, মার্কিন মুলুকেও সেটি দেখা যেতে পারে। টি-টোয়েন্টিতে এখন আড়াইশ রানের লক্ষ্যও নিরাপদ নয়। গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে বিশ্বকাপের সুপার এইটে যেতে হলে বাংলাদেশকে বড় লক্ষ্য দেওয়ার পাশাপাশি লক্ষ্য তাড়া করার মানসকিতাও তৈরি করতে হবে। তার জন্য সিঙ্গেল নয়, বাউন্ডারি হাঁকানোর দিকেই দিতে হবে নজর। টি-টোয়েন্টিতে ছোট-বড় দল বলে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। নিজেদের দিনে নেপাল-উগান্ডার মতো দলও চমকে দিতে পারে জায়ান্ট বধ করে। তবে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বড় হুমকি হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের খেলোয়াড়দের বিগ শট খেলার মানসিকতায় গড়ে দিতে পারে ম্যাচের পার্থক্য। হুমকি হতে পারে লঙ্কানরাও। শ্রীলঙ্কায় যে এখন ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেটি তো গত কয়েক সিরিজ ও টুর্নামেন্টেই দেখা গেছে।

বিগ শটের জন্য বাংলাদেশ দলে এতদিন তেমন কোনো খেলোয়াড় ছিল না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে জাকের আলি অনিক ও রিশাদ হোসেনকে কাজে লাগানো যেতে পারে। দুজনই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগের সিরিজে বাউন্ডারি হাঁকানোর সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছেন। ডেথ ওভারে রান বাড়ানোর জন্য দুজনকেই কাজে লাগানো যেতে পারে। সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞকে দলে রাখাও প্রয়োজন। শুরুটা একটু ঢিমেতালে করলও শট খেলা ও ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্য রয়েছে তার। তবে বড় স্কোরের জন্য টপ অর্ডারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ১২০ বলের ক্রিকেটে বল অপচয়ের মতো সুযোগ যে নেইÑসেটি মাথায় রেখেই টপ অর্ডারের ব্যাটিং লাইন আপ সাজাতে হবে বাংলাদেশকে। তবে এক্ষেত্রে ওপেনিংয়ে এখনো ভাবনা রয়েই যাচ্ছে। লিটন দাস ও সৌম্য সরকার যে লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও ধারাবাহিকতা প্রমাণ দিতে পারেননি! যার কারণে এ বিশ্বকাপেও ওপেনিং নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে দেখা যেতে পারে। তবে সেটি যদি প্রতি ম্যাচে হয়ে থাকে এবং ব্যর্থ হয় তবে বাকিদের মনেও প্রভাব ফেলতে পারে। বারবার ‘মেকশিফট’ ওপেনার দিয়ে কাজ চালানোর মতো পথে হাঁটলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।

এবার আসা যাক নারীদের ক্রিকেটে। আগামী জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় হবে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে হবে নারীদের এশিয়া কাপ। আট দলের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ পড়েছে ‘বি’ গ্রুপে। প্রতিপক্ষ মালেয়শিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড। ২০ জুলাই ডাম্বুলায় স্বাগতিকদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আসর শুরু করবেন নিগার সুলতানা জ্যোতিরা। এশিয়া কাপের প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশের মেয়েরা এরই মধ্যে সিলেটে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে শুরু করেছে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। গত জুলাইয়ের পর হারমানপ্রীত কৌররা আবার এলেন বাংলাদেশে। আগের সিরিজে রেফারিং বিতর্কে দুই দলের সিরিজে ছড়িয়েছিল উত্তাপ।

মেয়েদের ক্রিকেটে বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে জিতেছে বাংলাদেশ। তবে এরপর প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে আসা রেকর্ড ছয়বারের ওয়ানডে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ মোটেও ভালো কাটেনি জ্যোতিদের।

এশিয়া কাপের ফলাফল যাই হোক না কেন, সেসব মাথা ঝেড়েই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে নেমে পড়তে হবে বাংলাদেশের মেয়েদের। ঘরের মাটিতেই যে আগামী সেপ্টেম্বরে প্রথমবার মেয়েদের কোনো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ! এমন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রস্তুতির জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে জ্যোতিদের। ছেলে ও মেয়েদের বড় দুটি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ কতটুকু যাবে সেটির দিকে তাকিয়ে দেশের ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকেরা। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের পর অন্তত আরেকটি আইসিসি ট্রফির স্বপ্ন কী দেখতে পারে না বাংলাদেশের লাখো ক্রিকেট সমর্থক?

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ-2

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen + 13 =