কোরবানিতে সুস্থ থাকতে

ময়ূরাক্ষী সেন

কোরবানির ঈদ দরজায় কড়া নাড়ছে। কোরবানীর ঈদ মানেই যেন অফুরন্ত মাংস খাওয়া! ঈদের সকাল থেকে শুরু হয় মাংস খাওয়া, চলতে থাকে তিনবেলা। অনেকে মনে করেন একটাই তো ঈদ! বছরে প্রতিদিন তো আসবে না, তাই যত ইচ্ছা খেয়ে নিই; এতো হিসাবের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এর ফলে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। গরুর মাংস যদি লাগামহীনভাবে খাওয়া হয় তাহলে তো সমস্যা হবেই। তাই জেনে নেওয়া যাক কেমন করে কোরবানি ঈদে নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখবেন। অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারেÑ

গ্যাস্ট্রিক

গরুর মাংস সাধারণত অতিরিক্ত তেল মসলা দিয়ে রান্না করা হয়। গরুর মাংসে প্রাকৃতিকভাবেই অনেক চর্বি থাকে। যার ফলে পাকস্থলীতে এসিড জমা হয়, এতে হাইপার এসিডিটি হতে পারে। অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার জন্য পেটে আলসার অবধি হতে পারে। বুক ব্যথা কিংবা জ্বালা করা, পেট ফেঁপে থাকা, মল ত্যাগে সমস্যা ইত্যাদি সাধারণ গ্যাস্ট্রিকের লক্ষণ। অনেক সময় তীব্র পেট ব্যথা হতে পারে যা সহ্যের বাইরে চলে যায় তখন রোগীকে সাথে সাথে হাসপাতালে নিতে হয়। এ সময় বুকে চাপ অনুভব করে অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের মতো অনুভূতি হতে পারে। তবে তা হার্ট অ্যাটাক নাকি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তা শুধুমাত্র চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সনাক্ত করা সম্ভব।

ডায়রিয়া

পাকস্থলীতে ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে ডায়রিয়া হতে পারে। কোরবানির সময় হঠাৎ করে অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে দেখা যায়। অতিরিক্ত তেল মশলার কারণে ডায়রিয়া হতে পারে। আবার গরুর মাংস অনেকদিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া হয়। ফলে বাসি খাবারের জন্য ডায়রিয়া হতে পারে। ডায়রিয়ার পাশাপাশি বমি কিংবা বমি ভাব হতে পারে। ডায়রিয়া নিজে থেকে ভালো হয়ে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। তবে ডায়রিয়া হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যাবে না।

অন্যান্য সমস্যা

যাদের অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা রয়েছে যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা তাদের মাংস খাওয়ার আগে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ডায়াবেটিক থাকলে অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে রক্তের সুগার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত গরুর মাংস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে এবং সারা বছর ঔষধ খেতে হয় তাদের ক্ষেত্রে গরুর মাংস না খাওয়াই ভালো। দীর্ঘমেয়াদি যেকোনো ধরনের রোগ থাকলে কোরবানি ঈদের আগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কতটুকু মাংস খেতে পারবেন তা জেনে নিতে হবে।

মাংস খাওয়ার আগে যা জানা জরুরি 

কোরবানি ঈদে একদম মাংস খাবেন না তা তো সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে কতটুকু মাংস খেতে পারবেন তা নির্ভর করছে আপনার আদর্শ ওজনের উপর। ৬০ কেজি ওজনের একজন ব্যক্তির প্রোটিন গ্রহণের আদর্শ মাত্রা ৬০ গ্রাম। যদিও পুষ্টি নির্দেশনায় একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ নিরাপদ বলা হয়েছে। তবে ৭০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়। প্রতিবেলায় ১৫-২৫ গ্রাম অর্থাৎ ২-৩ টুকরা মাংস খাওয়া নিরাপদ। তাই যেকোনো দীর্ঘমেয়াদী রোগ বা অন্যান্য সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে হবে কতটুকু বা কি পদ্ধতিতে মাংস খেলে শরীরের বিশেষ ক্ষতি হবে না। কিডনি সমস্যার মতো অনেক জটিলতায় চিকিৎসক মাংস পরিহার করতে বলেন।

আমরা খাবারের পরিমাণ ও সময় বিবেচনা না করে যখন যা ইচ্ছা খেয়ে ফেলি। তাছাড়া ঈদের সময় শুধু যে গরুর মাংসই খাওয়া হবে তা নয়; সাথে থাকবে খাসির মাংসের রেজালা, বিরিয়ানি, পোলাও, জর্দা, সেমাই, পুডিং ইত্যাদি মিষ্টি জাতীয় খাবার। এসব বাড়তি খাবারও আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলবে। তাই যেকোনো খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই পরিমাণের কথা খেয়াল রাখতে হবে। কখন কি খাচ্ছি সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। গরুর মাংস কিংবা খাসির রেজালা হোক, যেকোনো খাবার শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমাণ বুঝে খেলে খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে না। তবে যারা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, তাদের জন্য প্রযোজ্য চিকিৎসকের দেওয়া খাবারের রুটিন। ঈদ উপভোগ করতে গিয়ে আমরা যদি পরিমাণের বেশি খাওয়া দাওয়া করে ফেলি তাহলে লাভের জায়গায় ক্ষতিই বেশি হবে। অসুস্থ হয়ে যতটুকু উপভোগ করা সম্ভাবনা থাকে তাও নষ্ট হয়ে যাবে।

কোরবানির মাংস কিংবা ঈদের রান্নায় কিছুটা পরিবর্তন আনলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো যেতে পারে। যেমন গরুর মাংস খাওয়ার সময় চর্বি ফেলে দিয়ে খেতে হবে, রান্নার সময় তেল কম দিতে হবে, বেশি করে সেদ্ধ এবং উচ্চতাপে রান্না করতে হবে। রান্নার সময় গরুর মাংসের মধ্যে পেঁপে, টক দই কিংবা ভিনেগার দিলে মাংস নরম হয়ে যায় এবং এতে হজমের সমস্যা হয় না। তাছাড়া তেল কম কিংবা তেল ছাড়া গরুর মাংস রান্না করার এখন বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। কিংবা জলপাই তেল বা সরিষার তেল দিয়ে গরুর মাংস রান্না করলে খেতেও যেমন মজাদার হয় তেমন স্বাস্থ্যকরও।

যারা সারা বছর স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করেন তারা হঠাৎ করে কোরবানির সময় যখন বেশি মাংস খেয়ে ফেলেন তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের ওজন দ্রুত বেড়ে যায়। তাই যারা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিংবা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন তাদের গরুর মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে দুই থেকে তিন টুকরার বেশি মাংস যাতে পাতে না থাকে। গরুর মাংস সবসময় যে ক্ষতিকর তা নয়, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে বা জিমে যায় তাদের প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করতে গরুর মাংস অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিমাণের কথা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু এটা সবারই জানা কথা যে কোরবানির সময় প্রতিবেলার খাবারে গরুর মাংস থাকবে তাই অন্যান্য খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। যেমন কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম রাখতে হবে। সাধারণত গরুর মাংসের সাথে ভাত কিংবা পোলাও খাওয়া হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ভাত বা পোলাও কম খেতে হবে কিংবা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্যকর উপায়ে খেতে চাইলে গরুর মাংসের সাথে লাল আটার রুটি কিংবা লাল চালের ভাত খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া শাক-সবজি, সালাদ ইত্যাদির পরিমাণ বেশি করে রাখতে হবে। যাতে গরুর মাংস কম খাওয়া হয়।

কোনো বেলায় যদি অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায় তাহলে পরের বেলায় তা ব্যালেন্স করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। অনেকে ভর পেট খেয়ে সাথে সাথে ঘুমাতে চলে যায়। কিন্তু এতে গ্যাস্ট্রিক, ওজন বেড়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। চেষ্টা করতে হবে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করার। এতে ওজন যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকবে তেমনি অন্যান্য রোগ হবার ঝুঁকিও কমে আসবে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলে রক্তের ফ্যাট ভেঙে শরীরের ওজন ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − twelve =