ক্রেনে বানানো হোটেল

রঙবেরঙ ডেস্ক

প্রথম দেখায় একে মনে হবে কেবলই পরিত্যক্ত একটা ক্রেন। একই সঙ্গে আবার মনে প্রশ্ন জাগবে এটা এখানে কেন? কিন্তু কাছে গেলে অবাক হবেন। আর অন্তঃপুরে প্রবেশ করলে চোখ কপালে উঠবে। কারণ পরিত্যক্ত এই ক্রেনকে ছোট্ট কিন্তু বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তর করা হয়েছে।

ক্রেন হোটেল ফারালডা নামের আশ্চর্য এই হোটেলে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে যেতে হবে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে। বন্দরে ব্যবহার করা একটি পরিত্যক্ত ক্রেনকে দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপনায় পরিণত করা নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি ব্যাপার। এ জন্য ২০১৬ সালে মর্যাদাপূর্ণ পিটার ভ্যান ভলেনহোভেন অ্যাওয়ার্ড পায় ক্রেন হোটেলটি।

হোটেলটির মালিক এডউইন করনমেনের সঙ্গে আমস্টারডামের আইএএ আর্কিটেকটেন এবং ভিনডিপি নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মিলিত চেষ্টা ও পরিকল্পনাতেই আলোর মুখ দেখে আশ্চর্য এই হোটেল।

প্রায় ৩০ বছর ধরে অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর ক্রেনটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ভেঙে ফেলা হয়। তারপর জাহাজে করে টুকরোগুলো ফ্রানকেরের তালসমা শিপইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে ইস্পাতের কাঠামোটিকে আগের চেহারা দিয়ে নতুনভাবে তৈরি করা হয়। বাইরের অংশটা রাঙানো হয় লাল রঙে। আর ভেতরটা রূপান্তরিত করা হয় আধুনিক, বিলাসবহুল এক হোটেলে। গোটা প্রক্রিয়াটি অবশ্য এক বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হয়।

স্যুইটগুলোর অবস্থান ৩৫ থেকে ৪৫ মিটার উচ্চতায়। একটি লিফট আপনাকে এখানকার লাউঞ্জ ও স্যুইটগুলোতে পৌঁছে দেবে। রিভার আইজের তীরে দাঁড় করানো ক্রেন হোটেল থেকে নদীর দৃশ্যের পাশাপাশি শহরের বাণিজ্যিক অংশের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়।

তৈরির পর থেকেই বৈচিত্র্যপিয়াসী মানুষদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে এটি। হোটেলটিতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকেই পর্যটকেরা আসেন। আসবেন না-ই বা কেন? একে তো ক্রেনকে বানানো হয়েছে হোটেল, তারপর আবার অতিথিদের আরাম-আয়েশে থাকার জন্য সব আয়োজনই রাখা হয়েছে এখানে। আর এখানে একটি রাত কাটানো অতিথিরা কিন্তু বেশ সন্তুষ্ট হোটেলের পরিবেশ ও সার্ভিসের বিষয়ে।

এদের একজন অস্ট্রীয় নাগরিক সুজান্না। তিনি বুকিং ডট কমে হোটেলটিতে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে, ‘আমি থেকেছি এমন সবচেয়ে চমৎকার জায়গাগুলোর একটি এটি। আমি বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান যে, অসাধারণ ফারালডা ক্রেনে জন্মদিনটা উদ্্যাপন করার সুযোগ পেয়েছি। এখানকার স্যুইটগুলো বিলাসবহুল। অসাধারণ আন্তরিকতা ও মুনশিয়ানার সঙ্গে এর নকশা করা হয়েছে। সিক্রেট স্যুইট (সুজান্না যে স্যুইটে উঠেছিলেন) থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমস্টারডামের দৃশ্য উপভোগ করেছি। হোটেলের কর্মচারীরা অবিশ্বাস্যভাবে সহজ-সরল, শান্ত এবং উদার। আপনি যদি বিশেষ একটি সময় কাটানোর জন্য অনন্য একটি জায়গা খুঁজে থাকেন, তবে এটিই সেটা।’

তিনটি চমৎকার স্যুইট পাবেন হোটেলটিতে। প্রতিটি স্যুইটের সাজ-সজ্জায় আছে ভিন্নতা। স্বাভাবিকভাবেই এগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আপনার সকালের নাশতা পৌঁছে দেওয়া হবে কামরায়।

ফ্রি স্পিরিট নামের স্যুইটটির আসবাব ও সাজ-সজ্জায় হালকা রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। কুইন সাইজের একটি বেডরুম আছে এখানে। বাথরুমে চমৎকার একটি বাথটাব পাবেন। এ ছাড়া আর্ম চেয়ার, এগ চেয়ার, প্লাজমা টিভি স্ক্রিন, মিনি বার পাচ্ছেন এখানে। পাশাপাশি হোটেলের স্পা পুলটি এখানকার অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত।

দ্য সিক্রেট স্যুইটটা ক্রেনের মেশিনারি রুমটিকে রূপান্তর করে বানানো হয়েছে। এখান থেকে নদী আর আমস্টারডামের মূল বাণিজ্যকেন্দ্র দুটোই চমৎকার দেখা যায়। আগে যে কামরাটির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, মোটামুটি সে সুবিধাগুলো পাবেন এখানেও। যুগলদের চমৎকার সময় কাটানোর জন্য একটি আলাদা জায়গা বা ‘লাভ নেস্ট’-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মিস্টিক স্লিপস নামের রুমটিতেও অন্য স্যুইটগুলোর মতো একটি কুইন সাইজের বেড আছে। সাধারণ সুবিধাগুলো পাবেন অতিথিরা। এর মধ্যে আছে আলাদা বাথরুম ও বাথটাব, ফ্রিজ, প্লাজমা টিভি, হ্যাংগিং চেয়ার ইত্যাদি। হোটেলের সবচেয়ে ওপরের তলায় স্পা পুলে সময় কাটানোর সুযোগ আছে অতিথিদেরও।

চমৎকার স্যুইটে রাতযাপন, ছাদের স্পা পুলে সময় কাটানো; ক্রেন হোটেলের ওপর থেকে মেগা সুইং এবং বাঞ্জি লাফের ব্যবস্থাও আছে। রোমাঞ্চপ্রেমী হলে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন। এই হোটেলে শিশুদের যাওয়া বারণ, কেবল প্রাপ্তবয়স্করাই এখানকার অতিথি হতে পারেন।

ছুটির দিনগুলোতে যদি অন্যরকম কিন্তু আরামদায়ক পরিবেশে সময় কাটাতে চান, তবে ক্রেন হোটেল আপনার জন্য আদর্শ। এক রাতে এখানে থাকার জন্য গুনতে হয় ১ লাখ টাকার বেশি।

সাগরের ওপর দিয়ে মহাসড়ক

আটলান্টিক মহাসাগর ও গালফ অব মেক্সিকোর মাঝখানের কোনো জায়গা। চিকচিক করা জলের ওপর গাঙচিলের ঝাঁক চেঁচামেচি জুড়েছে। আকাশের সমস্ত রঙ যেন গলে পড়েছে সাগরে, প্রবাল ও চুনাপাথরের দ্বীপের মাঝখানে প্রণালিতে পরিণত হয়ে যে ধারণ করেছে সবুজাভ-নীল রঙ। তবে এর বাইরে সাগরের যতদূর চোখ যাচ্ছে নীলের অবাধ বিস্তার।

চোখের রোদচশমাটা একটু ঠিকঠাক করতেই পাশে সাগরের জলে কিছু একটির আভাস। একটা বটলনোজ ডলফিন। আপনার আশপাশে অলস সময় কাটাচ্ছে জেলেদের নৌকাগুলো। আর আপনি বসে আছেন একটি গাড়ির ভেতরে, যেটি ৫০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে মহাসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়া ১১৩ মাইল লম্বা আশ্চর্য এক সড়ক দিয়ে।

অদ্ভুত সুন্দর এ পথের দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে মার্কিন মুল্লুকের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে। মহাসাগরের বুক চিরে যাওয়া মহাসড়কটি যুক্ত করেছে মূলভূমির সঙ্গে দুর্গম ফ্লোরিডা কিকে। বলা চলে এটাই বদলে দিয়েছে রাজ্যটিকে।

১২৫ মাইল দীর্ঘ অনেকগুলো দ্বীপের এক শিকলের মতো এই ফ্লোরিডা কি। আর এর প্রধান শহর বলতে পারেন কি ওয়েস্টকে।

তবে ফ্লোরিডার মিয়ামি থেকে কি ওয়েস্ট পর্যন্ত যাওয়া এখনকার মতো সহজ ছিল না আগে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে গোটা দিন লেগে যেত নৌকা বা জাহাজে সেখানে পৌঁছাতে। তারপরও গোটা বিষয়টি নির্ভর করত আবহাওয়া ও জোয়ার-ভাটার ওপর। এখনকার এই আয়েশি যাত্রার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে ১১৩ মাইল দীর্ঘ রাস্তা, যেটি মূলভূমির দক্ষিণ অংশ থেকে ছড়িয়েছে। এই পথে সে ৪৪টি দ্বীপের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে ৪২টি সেতুর মাধ্যমে। যাত্রাপথেই আশ্চর্য সুন্দর এক টুকরা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দেখা পেয়ে যাবেন, যেখানে উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এক হয়েছে।

মহাসড়কটির শুরু আসলে সাগরের ওপরের এক রেলপথের মাধ্যমে। আর এর মূল কৃতিত্ব আধুনিক ফ্লোরিডার জনক হিসেবে পরিচিত হেনরি মরগান ফ্ল্যাগারের। ফ্লোরিডা ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার পর্যটনের অপার সম্ভাবনা দেখে ফ্ল্যাগার তার সম্পদের বিশাল একটি অংশ ঢাললেন জায়গাটির উন্নয়নে।

এর অংশ হিসেবে ১৮৮৫ সালে আটলান্টিক উপকূলের ফ্লোরিডার উত্তরের সীমার জ্যাকসনভিলের সঙ্গে দক্ষিণের মিয়ামির কিছু বিচ্ছিন্ন রেলপথকে যুক্ত করলেন। এই রেলপথের শেষ হওয়ার কথা মিয়ামিতেই। তবে ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন পানামা খাল তৈরির কাজ শুরু করল, কি ওয়েস্টের জন্য বড় সম্ভাবনা দেখলেন ফ্ল্যাগার। ১৯০০ সাল পর্যন্ত কি ওয়েস্টই ছিল ফ্লোরিডার সবচেয়ে বড় শহর, তবে দ্বীপটির দুর্গম অবস্থানের কারণে উত্তরে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ ছিল ব্যয়বহুল ও ঝক্কির কাজ।

কাজেই ফ্ল্যাগার সিদ্ধান্ত নিলেন রেলপথটিকে ১৫৬ মাইল দক্ষিণে কি ওয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তৃত করার, যার বেশির ভাগটাই যাবে খোলা সাগরের ওপর দিয়ে। ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে নির্মাণ এলাকার ওপর আঘাত হানে তিনটি প্রচণ্ড হারিকেন। এতে প্রাণ যায় এক শ’র বেশি শ্রমিকের। তবে ফ্ল্যাগার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লাগে সাত বছর। খরচ হয় ৫ কোটি ডলার (এখনকার হিসাবে ১৫৬ কোটি ডলার)। রেলপথ তৈরি হয় ৪ হাজার আফ্রো-আমেরিকান, বাহামিয়ান ও ইউরোপীয় শ্রমিকের শ্রমে।

১৯১২ সালে রেলপথ তৈরির কাজ যখন শেষ হলো, তখন একে বলা হতো পৃথিবীর অষ্টম বিস্ময়। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত চালু ছিল রেলপথটি। তারপরই শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ হারিকেনে কয়েক মাইল রেলট্র্যাক পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। তবে এটাকে সংস্কার করার বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পানির ওপরের দীর্ঘতম সড়কগুলোর একটি তৈরি শুরু করল। আর এর বড় ভিত ছিল ফ্ল্যাগারের প্রায় ‘ধ্বংস করা অসম্ভব সেতু’গুলো। ২০০ মাইল গতির বাতাসের সামনেও যেগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

ওই সময় ফ্লোরিডা ইস্ট কোস্ট রেলওয়ের থেকে রাস্তার বেড ও রেলসেতুগুলো ফ্লোরিডা রাজ্যের পক্ষ থেকে কিনে নেওয়া হয় ৬ লাখ ৪০ হাজার ডলারে। অবশ্য গোটা সড়কপথটি নতুনভাবে তৈরি করতে হয়েছে তা নয়। এর কিছু কিছু অংশ রেলপথ চালু থাকার সময়ও ছিল। বলা চলে অনেক অংশেই সেতুগুলোর মাধ্যমে ওগুলোকে সংযুক্ত করা হয়। নতুন এই পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ১৯৩৮ সালে।

রেলপথ তৈরির পর এক শ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও মূল সেতুগুলোর ২০টি আজও মায়ামি থেকে কি ওয়েস্টের দিকে যাওয়া সড়কপথের যাত্রীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এমনিতে গোটা পথটি চার ঘণ্টার মধ্যে পাড়ি দিয়ে দিতে পারবেন। তবে পথে আপনাকে থামতেই হবে সাগরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে।

মিয়ামির ৬৯ মাইল দক্ষিণে পড়বে কিই লারগো। সেখানকার সাগরের জীববৈচিত্র্য দেখতে ভিড় জমান সাঁতারু ও ডুবুরিরা। শরীরটা শুকিয়ে আবার গাড়িতে চেপে পৌঁছে যাবেন আইলামোরাডায়। একটা সময় এখানে ছিল সাগরের ওপরের এক রেলস্টেশন। ৩৫ মিনিটের তথ্যচিত্রে আপনার সামনে নিয়ে আসা হবে রেলপথ তৈরির ইতিহাস ও নানা প্রতিবন্ধকতা।

এখান থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থান পিজিয়ন কি নামের ছোট্ট এক প্রবাল দ্বীপের।  সাগরের ওপরের রেলপথের সবচেয়ে জটিল ‘সেভেন মাইল ব্রিজ’ তৈরির জন্য ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ৪০০ শ্রমিকের আস্তানা ছিল জায়গাটি। এখন কেবল চারজন স্থায়ী বাসিন্দার আবাসস্থল দ্বীপটি। পাঁচ একরের দ্বীপটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে চমৎকার একটি জাদুঘরও পাবেন।

অসাধারণ সাগরের দৃশ্য এবং মিয়ামি ও কি ওয়েস্টের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সেতুবন্ধ হিসেবে এখন দারুণ জনপ্রিয় মহাসড়কটি। তা ছাড়া সড়কপথে কি ওয়েস্টে পৌঁছার একমাত্র রাস্তা এটি। এ ছাড়া যেতে পারবেন উড়োজাহাজ কিংবা উচ্চগতির ফেরিতে চেপে। তবে সড়কপথে চলতে চলতে সাগরের আশ্চর্য দৃশ্য দেখার সুযোগ মেলে কেবল এ রাস্তাটি ধরে গেলেই।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বিচিত্র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 + six =