গদখালী হাট: যেখানে শুধু ফুল বিকিকিনি

এই সবডি আমি নেব। দাম কত?

বিক্রেতা এমন কথা শুনে কিঞ্চিৎ রহস্য করে বললেন, দাম জানি না।

কথা শুনে ক্রেতা হো হো করে হেসে উঠে বললেন, এ কেমন বিক্রেতা যে দামই জানে না।

এমন হাস্যরসাত্মক গল্পটি গদখালী ফুলের হাটের। সচরাচর যেমন হয় তেমনই এ হাট। ক্রেতা বিক্রেতা, ব্যাপারী অন্য হাটের মতোই। পরিবেশও এক। শুধু পণ্যের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতির পসার বসে না। বসে না মৌসুমি ফসল বিকিকিনির আসর। গোটা হাটজুড়ে চোখে পড়ে শুধু ফুল। শুনে আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি। এখানে আসা লোকজনের উদ্দেশ্য একই। কেউ ফুল কিনতে আসে আর কেউ বিক্রি করতে। সপ্তাহে দুদিন বৃহস্পতি ও রোববার জমে ওঠে যশোরের গদখালি ফুলের হাট।

এটি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় অবস্থিত। যশোর থেকে বেনাপোল যাবার পথে ১৯ কিমি দূরে গদখালী বাজার। এখানেই সপ্তাহে দুই দিন বসে ফুলের হাট। এই হাট শুধুমাত্র ফুলের বিকিকিনিতে সরগরম হয়ে থাকে। ঝাঁকাতে বা মাটিতে কিছু বিছিয়ে গোলাপ গাদাসহ বিভিন্ন ফুল নিয়ে বিক্রিতে ব্যস্ত থাকেন বিক্রেতারা। পাশেই দেখা যায় গলায় মাফলার জড়িয়ে পান খেতে খেতে হিসাবে ব্যস্ত ব্যাপারি। দেখে মনে হবে ধান পাট গমের হিসাব করছেন তিনি। কিন্তু না। তার খাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় শুধু ফুলের নাম। একই ভাবে ঝাঁকাগুলো বাইরে থেকে দেখে মনে হয় মাছ বা অন্য কোনো মৌসুমি পণ্য সাজানো রয়েছে। কিন্তু উঁকি দিলেই দেখা যায় নানা রকম ফুল সাজানো রয়েছে এতে।

এমন চিত্র দেখে অনেকেই অবাক হন। এমন হাট আছে শুনে আকাশ থেকে পড়েন। অনেকের মাথায় ঘুরতে থাকে, কবে কিভাবে এই ফুলের হাট শুরু হলো। গল্পটা খুব বেশিদিনের না। মাত্র চার দশক আগের। তার আগে এ অঞ্চলের মানুষজনের চাষাবাদের চিত্র দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর মতোই ছিল। তারাও ধান গম ভুট্টাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফসল ফলাতো নিজেদের আবাদি জমিতে। শাক সবজি ধান পাট ফলাতে ফলাতে গান ধরত ভাটিয়ালি সুরে। এ গ্রামেরই এক বাসিন্দা শের আলী সরদার। তিনিও অন্যদের মতো চাষবাস করে খেতেন। শের আলী ১৯৮২ সালে কোনোকিছু না ভেবে নিজের এক বিঘা পরিমাণ জমিতে ফুলের চাষ শুরু করেন। এর পেছনে জড়িয়ে আছে একটি গল্প।

সে গল্প না হয় শোনা যাক এবার। একদিন নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন তিনি। সেসময় এক ভিনদেশি সাধু এসে তার কাছে পানি চান। সন্ন্যাসীকে পানি দেওয়ার সময় শের আলী খেয়াল করেন তার হাতে ফুল। এসময় ওই সাধু জানান ফুলটি তিনি নিজের দেশ ভারত থেকে নিয়ে এসেছেন। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে ফলানো হয় এগুলো। এ কথা শুনে নতুন ভাবনা দানা বাঁধে শের আলীর মাথায়। তিনি ভাবতে থাকেন ভারতের সাথে এদেশের মাটির ও আবহাওয়ার খুব একটা তফাৎ নেই। তাহলে পাশের দেশে ফুলের চাষ হলে এ দেশে হবে না কেন। ওই ভাবনা থেকেই প্রথম দিকে এক বিঘা জমিতে ফুলের চাষ শুরু করেন তিনি। সেসময় ফুল নিয়ে কোনো সুদুরপ্রসারী ভাবনা ছিল না তার। এদিকে মৌসুম শেষে হিসাবের খাতা খুলে তিনি দেখতে পেলেন আশাতীত লাভ হয়েছে। তা দেখে মনে মনে ভাবলেন, ধান গম ফলিয়ে এই লাভ উঠে আসত না তার। বেশ সাহস ও প্রেরণা পান তিনি। সেইসঙ্গে নতুন উদ্যোমে শুরু করেন  ফুল চাষ।

এদিকে শের আলীর এই কার্যক্রম নজরে পড়ে স্থানীয় চাষীদের। অল্প শ্রমে বেশি লাভ কে না চায়। তারাও ঝুঁকে পড়েন ফুল চাষের দিকে। প্রথমে অন্যান্য মৌসুমি ফসলের পাশাপাশি চাষ করলেও পরে বিস্তর লাভের সম্ভাবনা দেখে নিজেদের আবাদি জমির পুরোটাই ফুল চাষে ব্যবহার শুরু করে তারা। সেইসঙ্গে অন্য ফসলাদিও বিদায় নেয় তাদের চাষের তালিকা থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ গোটা গদখালি ভরে গেছে ফুলে ফুলে। জমিতে মখমলের মতো থরে থরে ফুটে থাকতে দেখা যায় হরেক রকম ফুল। তেমনই মেঠোপথের দুপাশও ব্যবহার করা হয় ফুল চাষে। প্রথমবার কোনো মানুষ এমন দৃশ্য মনে করতে পারেন গোটা গ্রাম যেন ফুলের বাগান। ফুলের অরণ্য দেখে মনে হয় যেন কোনো ফুলের রাজ্য এটি।

দেশের ৭০ ভাগের বেশি ফুলের চাষ হয় এই গদখালীতে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ফুল ব্যবসায়ী এখান থেকেই ফুল সংগ্রহ করে থাকেন। দেশের বৃহত্তম এই ফুলের হাট জমে ওঠে ভোর বেলায়। এখানে ফুল নিতে এসে জড়ো হন দেশের নানা জায়গার ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে তারা ট্রাক-পিকআপ করে ফুল নিয়ে যান নিজেদের ব্যবসাস্থলে।

কোন ফুলটি পাওয়া যায় না এই গদখালী ফুলের হাটে। গদখালীর ফুল চাষিরা সবধরনের ফুলই নিপুণ যত্নে ফলিয়ে থাকেন। ভোর পাঁচটা বাজতেই দেশি বিদেশি হরেক রকম ফুলে ভরে ওঠে এই হাট। এরমধ্যে গাঁদা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজি, জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির ফুল রয়েছে।

নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতে পারে কিভাবে বিক্রি হয় এই ফুল। স্থানীয় তরুণ কামাল মুস্তফা জানান, এর বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। কোনো ফুল বিক্রি হয় আঁটি বেঁধে আবার কোনো ফুল ওজন করে। এই যেমন গাদা ফুল। এগুলো বিক্রি হয় সংখ্যায়। কিন্তু হাজার হাজার ফুল কি গুনে বিক্রি সম্ভব? এরজন্য বিকল্প পদ্ধতি আছে। একটি ঝাঁকায় এক হাজার ফুল নেওয়া হয়। তারপর ওই হাজার খানেক ফুলের সমপরিমাণ ফুলকে অন্য ঝাঁকায় মেপে হাজার সংখ্যা বিবেচনা করে বিক্রি করা হয়। এই হাটের সুবিধা হচ্ছে এখানে মধ্যস্ততাকারী কেউ নেই। ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাষীদের কাছে থেকে ফুল কিনে থাকেন। ফলে লভ্যাংশ সরাসরি উৎপাদনকারীর হাতে গিয়ে পড়ে।

গদখালী হাটে সারা বছরই ফুল বেচাকেনা হয়। তবে বিকিকিনি জমে ওঠে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি জাতীয় দিবসের কারণে এই সময়টা দেশজুড়ে ফুলের চাহিদা থাকে। ফলে সেসময় ফুলের যোগান দিতে দেশের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে গদখালীর ওপর। আর ফেব্রুয়ারি মাস এলে তো কথাই নেই। এ মাসে জাতীয় দিবসসহ কয়েকটি দিবস পড়ায় চাষীরা ফুলের জোগান দিতে নাকে মুখে ব্যস্ত সময় কাটান। মুনাফাটাও এই মৌসুমেই তুলে নেন তারা। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশাল অংকের অর্থ আসে ফুল বিক্রি থেকে। এক জরিপে দেখা যায় সারা বছর ৪০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয় গদখালী হাটে। এরমধ্যে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয় শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই।

হাসান নীল

লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: কোথায় কি

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − five =