গর্ভবতী মায়ের পোশাক

নাহিন আশরাফ

তাসনুভার বয়স ২৮ বছর। প্রথম মা হতে যাচ্ছেন। তিনি অপেক্ষা করছেন তার সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবার। কিন্তু কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় তাসনুভার মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ সন্তান ধারণ করার পর থেকে স্বাভাবিকভাবে তার শারীরিক গঠনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের কোনো পোশাকই আর তার হচ্ছে না। অনেক সময় কোথাও ঘুরতে যাবার পরিকল্পনাও বাতিল করে দিচ্ছেন। কোনো পোশাকেই যেন নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। অথচ তিনি একসময় অনেক বেশ ফ্যাশন সচেতন ছিলেন। এখন ফ্যাশন থেকেই তার আগ্রহ উঠে যাচ্ছে। শুধু তাসনুভা না এমন হাজারো সন্তানসম্ভবা মায়ের নিত্যদিনের গল্প এটি। তাই তো তাদের পোশাক নিয়ে দুশ্চিন্তা কমাতে কাজ করছে ফ্যাশন হাউজ ও ডিজাইনার।

কেমন হওয়া উচিত একজন গর্ভবতী মায়ের পোশাক? ‘গর্ভবতী মায়েদের ফ্যাশনের থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আরামকে’ বলে জানান গাইনি বিশেষজ্ঞ নাসরিন আক্তার। কারণ এই সময়টা এমনিতেই মায়েদের উঠে বসতে ও চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। তার মধ্যে যদি পোশাক আরামের না হয় তাই সেটা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই পোশাক নির্বাচন করতে হবে খুব সচেতনভাবে।

হুর নুসরাতের ডিজাইনার নুসরাত আক্তার লোপা বলেন, গর্ভবতী হয়েছে বলে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কিছু নেই, প্রতিটা স্থানেই আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে উপস্থাপন করা সম্ভব যদি পোশাক ভেবেচিন্তে নির্বাচন করা হয়। স্থান, সময় ও নিজের শরীরের অবস্থা বুঝে একজন গর্ভবতী মায়ের পোশাক পরিকল্পনা করা উচিত। আমাদের আজকের আয়োজন কীভাবে একজন গর্ভবতী মা আরাম ও ফ্যাশন দুটিই বজায় রেখে নিজেকে তুলে ধরতে পারে।

ঢিলেঢালা পোশাক: গর্ভবতী মায়েদের আরামের সাথে কোনো প্রকার আপস করা যাবে না। তাই তো যেকোনো অনুষ্ঠানে চেষ্টা করতে হবে ঢিলেঢালা পোশাক বেছে নেবার। হরমোনের উঠানামার কারণে অনেকের গর্ভবতী হবার পর শরীরে গরম অনুভব হয় অন্যদের তুলনায় খুব বেশি। এছাড়া এই সময়টা অনেকের শরীরের পানি আসে ও কিছুটা মুটিয়ে যায়। তখন অনেক বেশি হাঁসফাঁস লাগে। তাই ঢিলেঢালা পোশাক বেছে নিলে খুব সহজে শরীরের ভেতরে বাতাস প্রবেশ করতে পারবে ও গরম কম অনুভূত হবে। এ সময়ের ট্রেন্ডি কাফতান পোশাক গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপযোগী হতে পারে। এটি যেমন ফ্যাশনেবল তেমন আরামদায়কও। এছাড়া বেছে নিতে পারেন ঢিলেঢালা পালাজ্জো, কামিজ, পায়জামা, ফতুয়া, টপস ইত্যাদি।

অফিস লুক: গর্ভাবস্থায়ও মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিয়মিত অফিসে যান। নিত্যদিনের অফিস লুকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান অনেকেই। সেজন্য বেছে নেওয়া যেতে পারে সুতি কিংবা লিলেনের কামিজ। কিংবা ফরমাল প্যান্টের সাথে কাফতান। অনেকেই অফিসে শাড়ি পরে যান। কিন্তু সম্ভব হলে গর্ভাবস্থায় নিত্যদিনের পোশাক শাড়ি এড়িয়ে যাওয়া ভালো। সালোয়ার কামিজ পরলে সাথে পরতে হবে ঢোলা পায়জামা। এছাড়া লেগিংস খুব ট্রেন্ডি, এটি সুতির কুর্তি সাথে বেশ মানানসই। গর্ভবতী থাকাকালীন এ-লাইন ড্রেস সব সময়েই আরামদায়ক এবং ফ্যাশনেবল। তাই প্যান্টের সাথে বেছে নেওয়া যেতে পারে এ-লাইন পোশাক।

স্কার্ট: অনেক নারীরাই নিজেকে একটু ভিন্নধর্মীভাবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন। তবে তারা কিন্তু চাইলে গর্ভাবস্থায়ও নিজেকে ভিন্নধর্মী রাখতে পারেন। তাই বেছে নেওয়া যেতে পারে স্কার্ট। স্কার্ট বেশ আরামদায়ক হয়ে থাকে। লং স্কার্ট এর সাথে কটন ফতুয়া কিংবা টপস পরা যেতে পারে। এছাড়া আজকাল অনেকে স্কার্ট-এর সাথে শার্ট পরছে। এ-লাইন স্কার্ট, প্লিটেড স্কার্ট, এমনকি শর্ট লেয়ারড স্কার্ট গর্ভাবস্থায় পরা যেতে পারে।

টিউনিক: কয়েক বছর ধরে ফিউশন ফ্যাশন বেশ চলছে। তাই ট্রেন্ডে এসেছে টিউনিক। ফ্যাশন সচেতন গর্ভবতী মায়েদের জন্য টিউনিক হতে পারে প্রথম পছন্দ। কাঁধ থেকে দেহের মধ্যভাগের নিচ পর্যন্ত কিংবা হাঁটু সমান লম্বা এই পোশাক যেমন ফ্যাশনেবল তেমন আরামদায়কও। টিউনিক সাধারণত একটু পাতলা ধরনের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। তাই গরমে যেমন পরতে আরাম তেমনি বর্ষায় ভিজলেও শুকায় তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি আর স্যাঁতসেঁতে গরম আবহাওয়ায় পোশাক ব্যবহারে আরামের কথা বিবেচনা করে বেছে নেওয়া যায় সুতি কাপড়, সিল্ক, মসলিন, এন্ডি সিল্ক, জয়শ্রী, এন্ডি কটন, জর্জেট, শিফনসহ অন্য আরামদায়ক কাপড়। তবে গর্ভকালীন সময়ে সুতির কাপড়কেই বেছে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

কার্গো: গর্ভবতী অবস্থায় জিন্স পরাটা কঠিন হয়ে যায়। কারণ জিন্স টাইট হবার কারণে শরীরকে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। কিন্তু অনেকে জিন্সে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই তারা বেছে নিতে পারেন কার্গো জিন্স। এটিতে বেশ স্মার্ট ও ফরমাল লুক দেওয়া যায়। জিন্স পরতে চাইলে নিজের সাইজ থেকে এক না দুই নাম্বার বড় সাইজের নিন, এতে চাপ ধরে থাকবে না।

ফরমাল লুক: গর্ভবতী মায়েরা খুব সহজে ফরমাল লুক দিতে পারে। লং শার্ট ও ফরমাল প্যান্ট পরে হুট করে কোথাও খুব আরামে বেরিয়ে পরা যেতে পারে। তবে এই সময়টা বেল্ট এড়িয়ে যাওয়া ভালো। এছাড়া পালাজ্জোর সাথে টপস কিংবা শার্টও পরা যেতে পারে।

উৎসবে: যেকোনো বিয়ে বা বড় আয়োজন হলে অনেক সময় গর্ভবতী মায়েরা পোশাক নিয়ে হিমসিম খান। তবে আয়োজন যাই হোক এই সময়টা যতটা হালকা থাকা যায়। শাড়ি পরতে চাইলে সুতি কিংবা লিলেনের শাড়ি পরা যেতে পারে। গয়না ভারী না পরাই ভালো। আরামের জন্য চুলে খোঁপা করা যেতে পারে। আর শাড়ি পরতে না চাইলে সালোয়ার-কামিজ বেছে নেওয়া যেতে পারে। কাতান কিংবা বেনারসির মতো ভারী শাড়ি না পরাই ভালো। গর্ভাবস্থায় শরীর এমনি ভারী লাগে, আবার পাশাপাশি শাড়িতে ভার থাকলে খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হবে। আর পায়ে হিল না পরে জুতি পরা যেতে পারে।

রঙিন থাকুন: গর্ভাবস্থায় হরমোনের তারতম্যজনিত কারণে অনেকে খুব বিষণ্নতায় ভোগেন। এছাড়া নতুন সন্তানের আগমনের দুশ্চিন্তাসহ নানা কারণে উদ্বেগ কাজ করে। আবার অনেকের কোনো কারণ ছাড়াই দিনের বেশিভাগ সময় মন খারাপ থাকে ও মুডের ওঠানামা হয়। এইসব মানসিক সমস্যা থেকে কিছুটা রেহাই পেতে যেকোনো পোশাকে উজ্জল রঙ বেছে নিন। যেমন লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনি, সবুজ, মেরুন ইত্যাদি। কারণ মনোবিজ্ঞানীদের মতে রঙের প্রভাব মনে উপর পড়ে। তাই সবসময় ফুরফুরে থাকতে চাইলে উজ্জ্বল পোশাক পরুন।

নাইট ড্রেস: গর্ভবতী মায়েদের ঘুমাতে যাবার পোশাক হতে হবে যথেষ্ট আরামের। সেক্ষেত্রে বেছে নিতে হবে সুতির ম্যাক্সি। এছাড়া কাফতান স্টাইলের নাইট ড্রেস পরা যেতে পারে।

আরামদায়ক ঢোলা টি-শার্ট ও ঢোলা পাজামা পরেও ঘুমাতে যাওয়া যেতে পারে। ফ্যাশন হাউজগুলোতে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য লম্বা পোশাক পাওয়া যায় সেসবও বেছে নেওয়া যেতে পারে।

একটা সময় গর্ভবতী মায়েদের কোনো পোশাক কিনতে পাওয়া যেত না। শরীরের পরিবর্তন আসার পরপরই তাদের কাপড় কিনে পোশাক বানাতে হতো। কিন্তু এখন ফ্যাশন হাউজগুলো গর্ভবতীদের জন্য রাখছে আলাদা কালেকশন। সে জায়গা থেকে খুব সহজেই গর্ভবতী মায়েরা কোনো ঝামেলা ছাড়া বেছে নিচ্ছেন তাদের পছন্দের পোশাক। দেশের স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজ আড়ং বিগত কয়েক বছর ধরে গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ কালেকশন রাখছে। সে পোশাকে আরামের কথা চিন্তার পাশাপাশি করা হয়েছে ট্রেন্ডি ডিজাইন। পোশাকগুলো এমন আকৃতিতে করা হয়েছে যার জন্য গায়ে আঁটোসাঁটো হয়ে থাকবে না। করা হয়েছে হাতের কাজ আবার এমব্রয়ডারিও। আড়ং এ রয়েছে গর্ভবতী মায়েদের জন্য বাহারি রঙের টপস, কামিজ, টিউনিক ইত্যাদি। এই কালেকশনের বেশিরভাগ পোশাকই সুতি কাপড়ে করা হয়েছে। ফ্যাশন হাউস সাদাকালোও রয়েছে গর্ভবতী মায়েদের পোশাক। পাওয়া যায় টপস ও ম্যাক্সিসহ নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় কালেকশন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

10 − 4 =