রঙবেরঙ ডেস্ক
পাতালের এক গুহায় ঢুকেছেন। আঁধারের রাজ্যে কিছুটা পথ এগোনোর পর আবিষ্কার করলেন গুহার ভেতরের দেয়ালে অগণিত খুদে আলোক উৎস দ্যুতি ছড়াচ্ছে। জ্বলজ্বলে জিনিসগুলো আসলে কী? সত্যি এমন পিলে চমকানো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন, যদি নিউ জিল্যান্ডের ওয়াইতমো গুহায় যান। এখানে প্রকৃতপক্ষে গুহা একটি নয়, অনেকগুলো। আর এগুলো পরিচিতি ওয়াইতমো গ্লোওয়র্ম কেভস নামে।
সময়টা ১৮৮৭ সাল, ইংরেজ জরিপকারী ফ্রেড মেইস এবং স্থানীয় মাওরি চিফ তানে তিনোরাও ওয়াইতমোর গুহাগুলোতে অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একটি ছোট ভেলায় চেপে একটি খাল ধরে পাতালরাজ্যে প্রবেশ করেন তারা। সঙ্গে থাকা মোমবাতির আলোয় পথ দেখে গুহার গভীরে ঢুকছিলেন। এ সময় হঠাৎ চমকে উঠলেন তারা, মাথার ওপর খুদে তারার মতো কী যেন জ্বলজ্বল করছে। ওগুলো আসলে ছিল হাজারে হাজারে গ্লোওয়র্ম। শান্তভাবে গুহার দেয়ালে আটকে থেকে দীপ্তি ছড়াচ্ছিল এরা।
এখন নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জাগছে এই গ্লোওয়র্ম জিনিসটা আবার কী? বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গের বায়োলুমিনিসেন্ট শুঁয়াপোকা বা শূককীট এরা। এখানে বলা রাখা ভালো, জীবন্ত জীবদেহ থেকে বিভিন্ন বর্ণের আলো তৈরি এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটানাটি হলো বায়োলুমিনেসেন্স বা জীব দ্যুতি। তো এই শূককীটদের একটি বড় অংশই গুবরে পোকা এবং আরাচনোকাম্পা নামের এক ধরনের ফাঙ্গাস গ্নাট বা ডাঁসের মতো পোকা। এরা প্রচুর পরিমাণে গুহার দেয়ালে আটকে থাকে। এদের বড় কোনো দলের দেখা পেলে সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। কারণ বড় একটা জায়গা তখন এদের দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করতে থাকবে।
এমন আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কারের পর ফ্রেড মেইস এবং তানে তিনোরাও আরও বহুবার গেলেন গুহাগুলোতে। পরের এক একক অভিযানে তিনোরাও ডাঙা দিয়ে গুহায় ঢোকার একটি পথও আবিষ্কার করে বসেন। এখন সারা পৃথিবীর পর্যটকেরা গুহার এ প্রবেশ পথটিই ব্যবহার করেন।
গুহাটিতে পর্যটকদের পদচারণা শুরু হয় সেই ১৮৮৯ সালে। তখন তিনোরা এবং তার স্ত্রী অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের গুহাটি ঘুরিয়ে দেখানো শুরু করেন। এখনকার অনেক টুরিস্ট গাইডই তিনোরা এবং তার স্ত্রীর বংশধর। আর ফাঙ্গাস গ্নাটরাও আগের মতোই জ্বলজ্বল করতে থাকে গুহার শরীরে। আর এটা দেখে মুগ্ধ হোন নিউ জিল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তের পর্যটকেরা।
গুহার ভেতরে একটি ভূগর্ভস্থ জিপ-লাইনে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ করতে করতে মুগ্ধ হবেন চুনাপাথরের সুড়ঙ্গ দেখে। রাবারের নৌকায় চেপে উপভোগ করতে পারবেন বিভিন্ন দেয়ালে মনোমুগ্ধকর আলোর খেলা। সেই সঙ্গে মাওরি গাইডের মুখে শুনবেন এই আদিবাসীদের সমৃদ্ধ লোককথা।
গুহাগুলো তিন কোটি বছর আগে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর জীবাশ্মের হাড় এবং খোলস দিয়ে প্রথম জলের নিচে তৈরি হয়েছিল। যা শক্ত হয়ে পাললিক শিলায় রূপ নেয়। মূলত টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে চুনাপাথর সমুদ্র থেকে ওঠে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির জল নালা, গুহা এবং পাথুরে তাকের জন্ম দেয়। ফলাফল প্রায় ১০০০ গুহার একটি নেটওয়ার্ক। এগুলোর মধ্যে মোটে ৩০০টির মতোর মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে এখন পর্যন্ত।
প্রথমে গুহায় প্রবেশ করলে জলের শব্দের সঙ্গে কেবল স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ পাবেন। কিন্তু শিগগিরই মাথার ওপরে বিস্ময়কর এক জগৎ আবিষ্কার করে বসবেন। অগণিত ক্ষুদ্র আলো আবছা সবুজ একটা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে গুহাময়। গ্লোওয়ার্ম তাদের শরীর থেকে নির্গত আলো খুদে পোকামাকড়কে প্রলুব্ধ করতে ব্যবহার করে। একদৃষ্টিতে তাকালে তাদের শরীরের আঠালো ও সরু সুতার মতো অংশগুলো দেখতে পাবেন, যেগুলো শিকারের অপেক্ষায় আছে।
কাজেই পাঠক এমন আশ্চর্য এক জগতের দেখা পাওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না আশা করি। নিউ জিল্যান্ডের রাজধানী অকল্যান্ড থেকে ঘণ্টা দুয়েকেই পৌঁছে যেতে পারবেন নর্থ আইল্যান্ডের ওয়াইতমোর ওই গুহারাজ্যে।
সাগরতলে রেস্তোরাঁ
পৃথিবীর নানা প্রান্তের সাগরতলে এখন এমন বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁই আছে। তবে এ ধরনের প্রথম রেস্তোরাঁ মালদ্বীপের কনরাড রিসোর্টের ইতহা আন্ডারসি রেস্টুরেন্ট। চারপাশে কাচের দেয়াল দিয়ে ঘেরা আশ্চর্য এ রেস্তোরাঁটির অবস্থান ভারত মহাসাগরে। সাগর সমতলের থেকে পাঁচ মিটার নিচে এটি।
২০০৫ সালে উদ্বোধন হয় রেস্তোরাঁটির। আপনার বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এর জুড়ি মেলা ভার। একবারে সর্বোচ্চ ১৪ জন অতিথির জায়গা হয় এখানে। স্থানীয় শব্দ ইতাহ অর্থ ‘মাদার অব পার্ল’ বা মুক্তার মা। এমন নামকে সার্থক করেই রেস্তোরাঁটি যেন ভারত মহাসাগরের ঢেউয়ের নিচে জ্বলজ্বলে এক মুক্তার মতো। এখান থেকে সাগরের অসাধারণ দৃশ্যে চোখ আটকে যাবে আপনার। হয়তো খাওয়া ভুলে দেখতে থাকবেন প্রবাল, কচ্ছপ, হাঙর, স্টিংরেসহ নানা ধরনের মাছ ও জলজ প্রাণীর আনাগোনা। অনন্য পরিবেশ ও মুখরোচক খাবার একে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননা, পুরস্কার পেতে সাহায্য করে।
রেস্তোরাঁটিতে লাঞ্চ এবং ডিনার করার সুযোগ আছে। সাধারণত মধ্যাহ্ন ভোজনে থাকে ৪ কোর্স এবং ডিনারে ৬ কোর্সের মেনু। এখানে নানা ধরনের খাবার পরিবেশিত হলেও সি ফুডের নামই বেশি। সি ফুড বা সামুদ্রিক খাবারের প্ল্যাটারে থাকে লবস্টার, সামুদ্রিক শামুক, ক্যাভিয়ার, গ্রিল করা মাছ প্রভৃতি।
রেস্তোরাঁটিতে প্রবেশ করতে হলে, জেটির শেষ মাথায় খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি মঞ্চ থেকে ঘোরানো সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসবেন। তারপর প্রবেশ করবেন বাঁকানো ছাদের একটি চওড়া সুড়ঙ্গের মতো দেখতে রেস্তোরাঁটিতে। ভেতর থেকে চারপাশের সাগরে ২৭০ ডিগ্রি ভিও পাবেন। রেস্তোরাঁটি তৈরি এবং নকশা করে নিউ জিল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এম জে মারফি লিমিটেড। সত্যি বলতে এটাই ছিল এ ধরনের প্রথম রেস্তোরাঁ যেখান থেকে সাগরের পরিষ্কার লেগুন, বর্ণিল প্রবাল বাগান, উষ্ণমণ্ডলীয় সব মাছের দেখা মেলে।
স্বাভাবিকভাবেই এখানে খাবারের দাম বেশ চড়া। মধ্যাহ্ন ভোজন জনপ্রতি ২৩৮ ডলারের (২৬ হাজার টাকা) আশপাশে এবং ডিনারে ৩৯০ ডলারের (৪৩ হাজার টাকা) মতো খরচ হবে। আর অবশ্যই আগে থকে রিজার্ভ করতে হয়।
এখানে মধ্যাহ্ন ভোজনে বাচ্চাদের নিয়ে আসতে কোনো সমস্যা নেই। তবে ডিনারে কেবল প্রাপ্তবয়স্করাই সময় কাটাতে এবং খেতে পারেন। কারণ ওই সময় অনেক অতিথিই নিজেদের মতো করে একটু শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে এবং খাবারটা উপভোগ করতে চান। এমনকি কনরাড রিসোর্টের বাইরের অনেক অতিথিও জীবনের বিশেষ কোনো সময়, মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে আসেন। বাচ্চাদের হই-হল্লায় যেন তাদের সমস্যা তৈরি করতে না পারে তাই এমন ব্যবস্থা।
ইতহা আন্ডারওয়াটার রেস্টুরেন্ট মোটামুটি সব ধরনের অতিথিদের জন্যই উন্মুক্ত। আপনি শুধুমাত্র আপনার পরিবার নিয়ে আসতে পারেন, তেমনি অফিসের সহকর্মীদের লাঞ্চ কিংবা ডিনার করার জন্যও বুক করতে পারেন। অবশ্য সে ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে দলের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়া চলবে না। প্রতি বছর মালদ্বীপ বেশ কিছু করপোরেট ভ্রমণকারীদের আপ্যায়ন করে, যার মধ্যে অনেকেই চীন থেকে আসেন।
গ্রুপ লাঞ্চ ছাড়াও রেস্তোরাঁটি যুগলের জন্য একান্ত নিজস্ব মধ্যাহ্ন ভোজনের একটি জায়গাও হতে পারে। বিশেষ করে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য জায়গাটি আদর্শ। তেমনি বিবাহবার্ষিকী উদযাপনে এটি একটি দুর্দান্ত স্থান হতে পারে। ফুল, পাম গাছের পাতা দিয়ে আপনার মনের মতো করে সাগরতলের ছোট্ট এই রাজ্যকে সাজিয়ে দেবে রেস্তোরাঁর কর্মীরা। কনরাডের পাশাপাশি অন্যান্য রিসোর্টে আসা অতিথিদের কয়েক মাস আগেই রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য বুকিং দিয়ে রাখতে দেখা যায়।
আপনাকে যেতে হবে কনরাড মালদ্বীপ র্যাংগালি আইল্যান্ডে। মালে থেকে জায়গাটির দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটার। সাধারণত সি প্লেনে যাওয়াটাই সবচেয়ে সহজ দ্বীপটিতে। সেখানে পৌঁছে গেল ওই সাগরতলের রেস্তোরাঁয় পৌঁছাতে কোনো সমস্যা হবে না, কারণ ওই দ্বীপের সাগর তলেই এর অবস্থান। কখনো মালদ্বীপ ভ্রমণে গেলে সাগরতলের রেস্তোরাঁটিকে একটা লাঞ্চ কিংবা ডিনার করার কথা ভাবতেই পারেন। বুঝতেই পারছেন গাঁটের পয়সা ভালোই খরচ হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বিচিত্র