সীমান্ত খান
রঙের সঙ্গে মস্তিষ্কের একটা সংযোগ রয়েছে। একেকটা রঙ এক ধরনের অনূভুতি জাগিয়ে তুলে। লাল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, আবার নীল বেদনার রঙ। আজকে একটি রঙ সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করবো তা হচ্ছে গোলাপি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পিংক। ১৭ শতকের শেষাংশে ‘পিংক’ শব্দটি ইংরেজি রঙ নাম হিসেবে প্রথম ব্যবহৃত হয়। ১৮ শতকের দিকে ইউরোপে গোলাপি রঙটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
গোলাপি রঙের সাইকোলজি
আমাদের সকলেরই কিছু পছন্দের রঙ রয়েছে। রঙ আমাদের স্বভাব ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। আপনার প্রিয় রঙ যদি হয় গোলাপি তাহলে আপনি খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। আপনি খুব দ্রুত কারও প্রেমে পড়ে যান। যারা গোলাপি রঙ পছন্দ করেন তারা খুব হাসিখুশি হয়। খুব লাজুকও হয়। তাদের বন্ধুবান্ধব অনেক বেশি হয়।
গোলাপিকে লাল রঙ বলা হতো
শুরুর দিকে গোলাপি রঙের বিশেষ কোনো নাম ছিল না। কারণ সকলে গোলাপি রঙকে লাল রঙ মনে করতো। গোলাপ ফুলের নাম অনুসারে গোলাপি রঙের নাম রাখা হয়। ফারসি ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন ইরান হতে মধ্য ফারসিতে রূপান্তরের সময় াধৎফধ শব্দটির (ৎফ) এর বদলে (ষ) হয় এবং শেষের ধ অক্ষরটি বিলুপ্ত হয়ে াধষ হয়। যা পরবর্তীতে ফারসি স্বরবর্ণ ‘া’ বদলে ‘মঁষ’ বা ‘মড়ষ’ করা হয়। ফারসি ভাষায় বহু শতাব্দী পর্যন্ত গোলাপকে ‘গুল’ বলা হতো এবং তা যে পানিতে জন্মতো তাকে ‘আব’ বলা হতো। যার কারণেই আমরা গোলাপ বা গুলাব নামের সঙ্গে পরিচিত হই এবং সেই গুলাবি শব্দটি বাংলা ভাষা গোলাপি রূপ পায়।
প্রাচীন রঙ গোলাপি
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক নুর গুয়েনেলি এই রঙের আদি পরিচয় জানার জন্য সাহারা মরুভূমিতে একটি গবেষণা করেন। গবেষণার সময় নুর মরুভূমির নিচে পশ্চিম আফ্রিকার মরিটেনিয়ার টাওদেনি বেসিনে একটি গোলাপি রঙয়ের পাথর খুঁজে পান। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি জানতে পারেন এই পাথরটি প্রায় ১১০ কোটি বছরের পুরানো। এই পাথরের ওপর গবেষণা চালিয়ে নুর গুয়েনেলি বলেন, পৃথিবীতে গোলাপিই হচ্ছে সবচাইতে পুরানো রঙ। তিনি বলেন, উজ্জ্বল গোলাপি রঞ্জক পদার্থটি হচ্ছে ক্লোরোফিল নামক আণবিক জীবাশ্ম। এই ক্লোরোফিল তৈরি হয় এক ধরনের সালোকসংশ্লেষকারী প্রাচীন সামুদ্রিক জীব থেকে। তবে ওই জীবটির অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু থেকে যায় তাদের তৈরি গোলাপি রঙ। গুয়েনেলি এই রঙ আবিষ্কারের জন্য ১০০ কোটি বছরের পুরানো পাথর গুঁড়া করে পাউডার তৈরি করেন। এরপর সেই পাউডার থেকে প্রাচীন জীবের কণাগুলো বের করে সেগুলোকে পরীক্ষা করেন। তখনই তিনি উজ্জ্বল গোলাপি রঙটি দেখতে পান।
গোলাপি শহর
মসজিদের শহর, নদীর শহর সম্পর্কে তো আমরা অনেকেই জানি তবে পৃথিবীতে এমন এক ধরনের শহর আছে যাকে পিংক সিটি বা গোলাপি শহর বলা হয়। এ শহরের অবস্থান ভারতের রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে। ১৮৭৬ সালে জয়পুরের রাজা ‘সওয়াই মাধো সিংহ’ শহরের পুরানো অংশের সব বাড়িঘরকে গোলাপি রঙ করার নির্দেশ দেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন যে জয়পুর একটি সুন্দর এবং উজ্জ্বল শহর হিসেবে পরিচিত হোক। যার কারণে জয়পুর গোলাপি শহরের তকমা পায়।
ধর্মীয় দিক থেকে গোলাপি রঙ
ফ্যাশনের পাশাপাশি গোলাপি রঙ ধর্মীয় দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। খ্রিষ্টানরা গোলাপি রঙকে পবিত্র মনে করে। তাই তারা ভার্জিন মেরিকে গোলাপি ফুল দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে। এছাড়াও গোলাপি রঙকে খ্রিষ্টানরা বিবাহের প্রতীক মনে করে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা গোলাপি রঙের আধিক্য বজায় রাখতে পছন্দ করে, তারা মনে করে গোলাপি রঙ সকল খারাপ জিনিস ও কাজ থেকে তাদের দূরে রাখবে।
গোলাপি জলপ্রপাত
পানি দেখতে সাধারণত নীল এবং সবুজ রঙের হয়। কিন্তু কানাডায় রয়েছে ভিন্ন একধরনের জলপ্রপাত যার রঙ গোলাপি। কানাডার অ্যালবার্টা ওয়াটরন লেকস ন্যাশনাল পার্কের ক্যামেরন জলপ্রপাতে এ রকম গোলাপি রঙের জলধারা দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বলেন, যেদিন খুব বৃষ্টি হয়, সেদিনই গোলাপি পানির ধারা নেমে আসতে দেখা যায় পাহাড়ের ওপরের নদী থেকে। মূলত জলপ্রপাতের পানি গোলাপি হওয়ার জন্য দায়ী পাহাড়ের ওপরের দিকের মাটিতে অ্যাগ্রোলাইট নামে এক রাসায়নিক পদার্থ। যা বৃষ্টির জলের সঙ্গে ধুয়ে নদীতে মিশলে পানির রঙ খানিকটা লাল বা গোলাপি হয়ে ওঠে।
গোলাপি বালির দ্বীপ
পৃথিবীতে এমন এক ধরনের অদ্ভুত সমুদ্র সৈকত রয়েছে যার বালু দেখতে গোলাপি রঙের। এই অদ্ভুত জিনিসটি দেখতে হলে যেতে হবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশ বাহামার ছোট্ট এক দ্বীপ হারবার আইল্যান্ড। এটির অবস্থান পূর্ব আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে। সেখানে গেলে প্রথমেই আপনার চোখ আটকে যাবে এর অদ্ভুত সুন্দর গোলাপি বালুতে। দৃশ্যটি দেখার পর অনেকের প্রশ্ন আসতে পারে কিভাবে সৈকতের বালু এমন গোলাপি রঙ পেল! যার কারণ বালুতে থাকা ফোরামিনিফেরা নামের একটি অতি ক্ষুদ্র প্রাণী।
গোলাপি পাহাড়
পাহাড় বলতে আমরা মূলত সবুজ গাছের সমাবেশকে বুঝে থাকি। তবে সব পাহাড় সবুজ হয় না। কিছু বিচিত্র ধরনের পাহাড় পৃথিবীতে বিরাজ করে। তেমন একটি পাহাড় হলো নেত্রকোনার ‘সুসং দুর্গাপুর’। এই পাহাড়ে রয়েছে গোলাপি রঙের মাটি, যা দেখতে খুবই বিস্ময়কর। এটি টারশিয়ারি যুগের একটি পাহাড়। মাটির ভেতরে থাকা চুনামাটি পাহাড়টিকে গোলাপি করে তুলেছে। চিনামাটি উত্তোলন বন্ধ থাকায় কারণে এটি পরিণত হয় দেশের অন্যতম একটি টুরিস্ট স্পটে।
গোলাপি ডলফিন
বিশ্বজুড়ে ৪০ প্রজাতির অধিক ডলফিনের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিরল প্রজাতি হলো গোলাপি ডলফিন। অধিকাংশ গোলাপি ডলফিন দেখতে পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে। তাই অনেকে প্রাণিটিকে ‘আমাজন রিভার ডলফিন’ নামেও ডাকেন। নদীতে বসবাসকারী ডলফিনের চারটি প্রজাতির মধ্যে গোলাপি ডলফিন আকৃতিতে সবার বড়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইনিয়া জিওফ্রেনসিস’। এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকই হচ্ছে এদের গায়ের বর্ণ।
ফ্যাশনে গোলাপি রঙ
ফ্যাশনে গোলাপি রঙ বরাবরই তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। মধ্যযুগের ফ্যাশনে গোলাপি সাধারণ রঙ ছিল না, এটিকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হতো। ফ্রান্সের রাজ লুই ১৭২১ থেকে ১৭৬৪ সাল পর্যন্ত গোলাপি রঙের পোশাক পরতেন। এছাড়া তার আশেপাশে গোলাপি রঙের আধিক্য রাখতেন। উনিশ দশকে ইংল্যান্ডে অল্প বয়স্ক ছেলেদের পোশাক গোলাপি রঙের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পোশাক লাল রঙের ছিল। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া তার সপ্তম সন্তান এবং তৃতীয় পুত্র প্রিন্স আর্থারের পোশাক গোলাপি রঙের বানাতেন।
সাহিত্য চর্চায় গোলাপি রঙ
গোলাপি রঙটি প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্য চর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত লেখক লুক্রেটিয়াস ‘অন দ্য নেচার অফ থিংস’ বইটিতে প্রথম গোলাপি রঙ সম্পর্কে সকলকে জানান। বইটিতে তিনি ল্যাটিন শব্দ ‘রসি’ ব্যবহার করেন যার বাংলা অর্থ গোলাপি। এছাড়াও অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মে গোলাপি রঙের প্রভাব দেখা যায়।
সচেতনতায় গোলাপি রঙ
১৯৯১ সাল থেকে পিংক রিবন স্তন ক্যান্সার সচেতনতার প্রতীক। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে সারাবিশ্বে পিংক অক্টোবর পালিত হয় ব্রেস্ট ক্যান্সারের সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য। নানা ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে এটি পালিত হয়। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস উপলক্ষ্যে ব্রাজিলের জাতীয় কংগ্রেসে গোলাপি আলো জ্বালানো হয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা