ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনালকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, শিগগিরই অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। ভাসমান টার্মিনালের চেয়ে ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল অনেক সাশ্রয়ী বলে মন্তব্য করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) পেট্রোসেন্টারে আয়োজিত এক সেমিনার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন। জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা ও চ্যালেঞ্জে মিডিয়ার ভূমিকা শীর্ষক ওই সেমিনারে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের সদস্যরা অংশ নেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আরও বলেন, গতকালও (২৮ জুলাই) আমরা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছি ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল ও এলপিজি বোটলিং প্লাণ্টের জায়গার বিষয়ে। আরেকটি বৈঠকে বিষয়টি চুড়ান্ত হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনার এর অগ্রগতি দেখতে পাবেন। তবে বিষয়টি অনেক সময় সাপেক্ষ।
তিনি বলেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কম। আর কিছুদিন পরেই ইউরোপে শীতের প্রকোপ বেড়ে গেলে দাম বেড়ে যাবে। আমাদের ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল থাকলে এখন কমদামে কিনে মজুদ করতে পারতাম। তাহলে শীতের সময়ে বেশিদামে এলএনজি আমদানি করতে হতো না। চোখের সামনে দেখছি খরচ বেশি পড়ছে কে-না চাইবে সাশ্রয়ী দাম নিশ্চিত করতে!
অপর এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ নিরোৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। আমরা আর দশ মেগাওয়াটের বেশি কোন প্রকল্পে গ্যাস সংযোগ দিবো না। এখন যেমন ক্যাপটিভ রয়েছে সেগুলো ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে চাই।
শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগে হয়রানির বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, শিল্পে গ্যাস সংযোগ ৩টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এক হচ্ছে গ্যাস সংযোগ পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে যেতে পারবে। সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সংযোগ প্রদান, এ জন্য বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া তালিকা নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে চুড়ান্ত করবে। কয়েকটি কোম্পানির পরিদর্শন কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এখানে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কোন সুযোগ থাকছে না। আর যেগুলো ভবিষ্যতে আসতে চায় তাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিবেচনা করে তারপর চুড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ৫০ কূপ খনন প্রকল্পের পাশাপাশি ১০০ কূপ খনন প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। আমরা আশাকরছি এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন অনেক বাড়বে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপরেশন অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০০ কূপ প্রকল্পের আওতায় ৬৯টি অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে। এর মাধ্যমে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন আরও ৯৮৫ মিলিয়ন বাড়বে। আর ৩১ ওয়ার্কওভার থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন উৎপাদন বাড়বে। ১০০ কূপ থেকে ১৯টি কূপ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চুড়ান্ত করা হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হলে ওই ১৯টি কূপ থেকে ২৭৭ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য ২টি নতুন রিগ কেনা হচ্ছে। একটি রিগ ক্রয়ের প্রস্তাব খুব দ্রুতই একনেকে উঠবে। আরেকটির প্রাক সমীক্ষা চলমান রয়েছে। এগুলো হলে কূপ খনন কার্যক্রম আর দ্রুততর করতে পারবো। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরো ভোলা জেলার সিসমিক সার্ভে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি সেখানেও আমাদের মজুদ বৃদ্ধি পাবে।
গ্যাসের সিস্টেম লস এবং অবৈধ সংযোগ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিস্টেম লস কমানোর জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করার জন্য ৪ জন ডেটিকেটেড নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছে। তারা প্রতিদিনেই অভিযান পরিচালনা করছে। যার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। পাশাপাশি গ্রাহক ও সংবাদকর্মীদের সহায়তা প্রয়োজন। আপনাদের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাড়া দিতে চাই।
তিনি বলেন, দিনের শেষে যখন আমি অফিস থেকে বের হই, তখন আমিও পেট্রোবাংলার একজন ভোক্তা। এর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে।
পেট্রোবাংলা পরিচালক (অর্থ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, গত এপ্রিল মাস থেকে পেট্রোবাংলা কাছে কারো কোন পাওনা নেই। এতে করে পেট্রোবাংলার প্রতি অন্যদের আস্থা বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৪ হাজার কোটি টাকার বিজনেস হয়েছে। এরমধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। বকেয়ার দিক থেকে বিদ্যুৎ ও সার কারখানা শীর্ষে রয়েছে। এই বকেয়া ১৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি। ক্রয় এবং বিক্রয়ের মধ্যে বর্তামানে ৪.৬০ (ঘনমিটার প্রতি) টাকা গ্যাপ রয়েছে। ধীরে ধীরে প্রাইপ গ্যাস দ্রুত করে ভর্তুকি কমাতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম সেভাবে করা যায়নি। যে কারণে আজকে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনেই কমছে উৎপাদন, যেকোন দিন আরও বড়ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। কূপ খনন আরও বাড়ানো উচিত, না হলে আমদানি করে গ্যাস সংকট মোকাবিলা করা কঠিন। গভীর সমুদ্রে মনযোগ দেওয়া উচিত।
পেট্রোবাংলার পরিচালক আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী, পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব, পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) আলতাফ হোসেন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীর, পেট্রোবাংলা ও বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ আলোচনায় অংশ নেন।