গ্যাস সেক্টরের ত্রিশংকু অবস্থা : দায় কার?

সালেক সুফী

বর্তমান জ্বালানি খাতের শোচনীয় দুরবস্থার ও অনিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য পেট্রোবাংলার সীমাহীন ব্যার্থতা দায়ী। একথা এই সেক্টরের তিন দশক গৌরব সময়ের মাঠ কর্মী হিসাবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। মাটির নিচে পড়ে আছে মূল্যবান কয়লা সম্পদ, স্থলে, সাগরে আছে অনাবিষ্কৃত বিপুল পেট্রোলিয়াম সম্পদ। অথচ গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার উৎপাদন, শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা আছে তীব্র সংকটে। পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলো থেকে ওদের সঞ্চিত সম্পদ নিয়ে তহবিল শুন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ,সারকারখানা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর কাছে আছে বিপুল বকেয়া। সুশাসনের অভাবে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোতে গ্যাস চুরির মহোৎসব। পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিগুলো থেকে বিপুল সংখ্যায় মেধাপাচার হওয়ায় দক্ষ, যোগ্য লোকের সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়েছে। আমি নানা সময়ে পেট্রোবাংলার বর্তমান  চেয়ারম্যানের নানা উদ্যোগের কথা শুনেছি।  বিপুল দায় দেনা, সীমিত সামর্থ্য নিয়ে উনি অসহায় বোধ করছেন। ঠিক যেন সীমিত সামর্থ্যের অসহায় বাবার হাহাকার।

আমি ২০০৯-২০২৩ তিন দফায়  বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সমসয়কালের কথাই বলবো।  এই সময়ে ক্ষমতাশীল সরকার ভ্রান্ত পরামর্শে গ্যাস খাতকে নিরংকুশ আমলা নির্ভর করে জাতির জনকের স্বনির্ভর জ্বালানী দর্শন থেকে  সরে গেছে বহুদূর। পেট্রোবাংলার শীর্ষ পদ এবং কোম্পানিগুলোর পরিচালক মন্ডলী একান্ত ভাবেই আমলা নির্ভর। কয়লা আহরণের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাপেক্সকে নিয়ে শাপলুডু  খেলেছে সরকার। সরকার নিজেই বলছে গ্যাসের অভাবে ৪০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে আছে। মাটির নিচে উঁচু মানের কয়লা সম্পদ থাকলেও আমদানী নির্ভর কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে গেছে সরকার। সেখানেও রয়েছে আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। ভারতের একটি কোম্পানি কয়লা আমদানী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাংলাদেশে রপ্তানি করছে। গ্যাস  বিতরণ এলাকায় বিপুল পরিমান গ্যাস চুরির জন্য বর্তমান সরকারের ব্যার্থতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।  নিজেদের কোম্পানির ব্যাবস্থাপনায় মাতারবাড়িতে স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ কাজ নানা অজুহাতে ঝুলে আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সাগরে ভাসমান টার্মিনাল থেকে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে সরকার। সাগর সম্পদ বাদ দিলাম স্থলভাগে বিপুল পরিমান গ্যাস সম্পদ অনাবিষ্কৃত থাকার তথ্য সরকারের হাতে থাকলেও দুর্বল ব্যাবস্থাপনার জন্য অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বাপেক্সকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী না করে হাত পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলা হয়েছে স্থলভাগে অনুসন্ধানের একক দায়িত্ব দিয়ে। সুযোগ থাকা এবং সামর্থ থাকা সত্ত্বেও অনেক কাজ বেশি খরচে বিদেশী কোম্পানী দিয়ে করানো হয়েছে।  দুর্নীতির কথা নাই বা বললাম।

যে ধারায় চলছে অবিলম্বে কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলে ২০২৪, ২০২৫ জ্বালানি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। নিজেদের গ্যাস উৎপাদন আশংকাজনক ভাবে কমতে থাকবে। জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করা যাবে না। মুখ থুবড়ে পড়বে শিল্প খাত ,

এতো দিন পরে বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর বোধোদয় হয়েছে নিজেদের গ্যাস সম্পদ দ্রুত তুলতে হবে।  এখন যদি নিজেদের ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা করা যায় তাহলে এতদিন কেন সরকার ঘুমিয়ে ছিল ? লজ্জার বিষয় হচ্ছে একসময় ভারত বিবিয়ানা থেকে গ্যাস আমদানিতে আগ্রহী ছিল। এখন ভারতীয় কোম্পানি ভারতে এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশে রপ্তানী করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন করি কেন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান এক যুগ পিছিয়ে গেলো? জানি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে জ্বালানি সেক্টর। কিন্তু হটাৎ করে সাগরে, স্থলে বিপুল অনুসন্ধান কাজ ব্যাবস্থাপনা, গ্যাস বিতরনে স্বচ্ছতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল ঘাটতি আছে পেট্রোবাংলায়। সরকারের হাতে বিকল্প আছে দেশে থাকা অনেক প্রমাণিত দক্ষ গ্যাস সেক্টর অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা।বিশেষ ব্যাবস্থায় এদের থেকে যোগ্য কয়েকজনকে পরামর্শক হিসাবে পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিগুলোর পরিচালনায় সম্পৃক্ত করার।  জ্বালানী সেক্টর একান্ত কারিগরী ঘন কাজের স্থান। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের এখানে পদায়ন করে সংকট সৃষ্টি করার হয়েছে। বিপুল সংখ্যক দক্ষ যোগ্য কর্মকর্তা সেক্টর ছেড়ে প্রবাসে অথবা দেশে প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করছে।

জ্বালানি সেক্টর দক্ষ না হলে কোনোভাবে নির্ভরযোগ্য জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। ২০৩০, ২০৪১ সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিত হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সালেক সূফি, পেট্রোবাংলার সাবেক কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − 4 =