ঘরের সৌন্দর্যে দোলনা

ময়ূরাক্ষী সেন

দোলনা শব্দটা শুনলেই চোখে ভেসে উঠে সেই ফেলে আসা স্কুল মাঠ। সবাই স্কুল ছুটির পর লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো কে কার আগে দোলনা দখল করতে পারে। কিন্তু দোলনা এখন আর স্কুল মাঠে আবদ্ধ নেই, এটি চলে এসেছে ঘর সাজানোর অনুষঙ্গ হিসেবে। ঘরের খালি জায়গায় বাঙালিয়ানা ও নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলার জন্য সৌখিন মানুষ বেছে নিচ্ছে দোলনা।

দোলনার সৃষ্টি কিন্তু অনেক বছর আগে। বলা হয় বহু যুগ আগে দোলনা ব্যবহার করা হতো প্রয়োজনে। মায়েরা ঘরের কাজ করতে যাবার আগে ছোট শিশুদের দোলনায় ঘুম পাড়িয়ে যেত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৫০ এবং ১৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে দোলনা আবিষ্কার হয়েছিল। ভিক্টোরিয়ান যুগে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হবার কারণে শিশুরা খেলাধুলায় মেতে উঠেছিল। তখন খোলা মাঠে তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল দোলনা। এরপর ধীরে ধীরে দোলনা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। খেলার মাঠ থেকে চলে যায় গৃহসজ্জায়।

কেমন দোলনা দিয়ে ঘর সাজাবেন এটা ঠিক করার আগে মাথায় রাখতে হবে আপনার ঘরের সাইজ ও ধরন। সাধারণত দোলনা সব ঘরেই মানিয়ে যায়। কিন্তু ছোট ঘরে বড় সাইজের একটা দোলনা মানানসই হবে না। তাই সব কিছু বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড্রয়িং রুমে দোলনা রাখার কথা ভাবলে অবশ্যই রুমের অন্যান্য ফার্নিচারের কথা খেয়াল রাখতে হবে। বাকি ফার্নিচারে থিম ও ডিজাইনের সাথে মিলিয়ে দোলনা বাছাই করলে দেখতে বেশ সুন্দর লাগবে। বিশেষ করে ড্রয়িং রুমের সোফার কুশনের সাথে মিল রেখে দোলনার কুশন ঠিক করা যেতে পারে। বেড রুম বড় হলে চাইলে বেড রুমের খালি জায়গাও দোলনা রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বেড রুমের পর্দার সাথে মিলিয়ে দোলনার থিম ঠিক করতে হবে। আবার চাইলে কনট্রাস্ট রঙ বাছাই করা যেতে পারে। যেমন পর্দার রং হালকা হলে বেছে নিতে পারেন গাঢ় রঙের দোলনা। বেড রুমের এককোণে দোলনা রাখুন যাতে চলাফেরায় খুব সমস্যা না হয়।

চেষ্টা করতে হবে বেড রুমের দোলনাটা যাতে সাইজে ছোট হয়। কারণ বেড রুম যত বড় হোক না কেন, খুব বড় সাইজের দোলনা রাখলে তা দৃষ্টিনন্দন হয় না। ছোট বাচ্চাদের রুমে দোলনা যাতে নিচু হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দোলনাতে উঠতে গিয়ে বাচ্চা যাতে ব্যথা না পায়। অন্যান্য আসবাব থেকে দোলনা যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। কারণ দোলনা আর বাকি আসবাব কাছাকাছি থাকলে দোল খাওয়ার সময় ব্যথা পেতে পারে। আর বাচ্চাদের রুমের দোলনা একটু উজ্জ্বল রঙের বেছে নেওয়া যেতে পারে। দোলনায় শিশুদের পছন্দের কার্টুন মোটিভের কুশন দিতে পারেন। বারান্দা বড় হলে বড় দোলনা বেছে নেওয়া যেতে পারে। তবে আজকাল বাড়ির বারান্দা সাধারণত ছোট হয়ে থাকে। বারান্দা ছোট হলে দোলনা না রাখাই ভালো। আর রাখতে চাইলে এক সিটের গোল দোলনা বেছে নিতে হবে।

দোলনা ঢেকে দেওয়ার জন্য একটি চাদর রাখতে হবে; যাতে বৃষ্টি হলে সাথে সাথে ঢেকে দেওয়া যায়। ছাদ হলো দোলনা রাখার জন্য সবচেয়ে উপযোগী স্থান। ছাদের জন্য আপনার পছন্দ মতো যেকোনো সাইজের দোলনা বেছে নিতে পারেন। তবে ছাদে দোলনা রাখতে চাইলে ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ছাদের দোলনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। দোলনা ছোট হোক বড় হোক; যাতে আরামদায়ক হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দোলনা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। অন্যান্য আসবাবের মতো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে নিলেই যথেষ্ট। দোলনার কুশন যত সুন্দর হবে দোলনা তত দৃষ্টিনন্দন হবে। মাঝে মাঝে কুশনগুলোও রোদে দিতে হবে। দোলনার দড়ি যাতে মজুবত হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

কেমন দোলনা বাছবেন

ঝুলন্ত দোলনা: এমন দোলনা বেশ আরামদায়ক হয়। ঝুলন্ত দোলনা সাধারণত একজন বসার উপযোগী হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির এই ঝুলন্ত দোলনা রাখতে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। তাই বেড রুমে এই দোলনা রাখা করা যায়।

কাঠের দোলনা: ঘরের কোণে একটি কাঠের দোলনা বেশ নান্দনিক ও রুচির পরিচয় দিয়ে থাকে। কলকাতার কিছু পুরোনো বাড়িতে কাঠের দোলনার প্রচলন দেখা যেত। এখনও অনেকের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয়। কাঠের দোলনায় নানা ধরনের কারুকাজ থাকে। ফুল, লতাপাতা নকশাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। কাঠের দোলনা বড় ড্রইং রুমের জন্য বেশ মানানসই।

পাটের দোলনা: পাটের দোলনা এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কারণ এটি ছোট ফ্ল্যাটেও খুব সহজে মানিয়ে যায়। ছোট বাড়ি বলে অনেকেই চিন্তিত থাকেন, কিভাবে সাজাবেন। তারা বেছে নিতে পারেন পাটের দোলনা। ড্রয়িংরুম হোক, বারান্দা হোক কিংবা শোবার ঘর; পাটের দোলনা সব জায়গায় ভালো লাগে। বিশেষ করে যাদের ছোট বারান্দা, তারা দোলনা লাগাতে চাইলে পাটের দোলনা বেছে নিতে পারেন। এটা যখন তখন রিং থেকে খুলেও ফেলা যায়।

বেতের দোলনা: ঘরে দেশীয় ছোঁয়া আনতে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বেতের দোলনা। এটি কারিগরটা নিজের হাতে বুনে থাকে বলে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ধারণ করে থাকে। পাটের মতো বেতের দোলনাও সব জায়গায় মানিয়ে যায়। বেতের দোলনা নানা আকৃতির হয়ে থাকে। ঘরের ধরন বুঝে বেছে নিতে হয়।

বিভাজন দোলনা: চারকোনা এই দোলনার জন্য বেশ জায়গার প্রয়োজন হয়। যাদের ঘর বড় তারা বেছে নিতে পারেন। বিভাজন দোলনা বেশ অভিজাত। ড্রয়িং রুমে অন্যান্য আসবাব কম থাকলে বিভাজন আকারের দোলনা ড্রয়িংরুমকে পূর্ণতা দেয়। বাড়িতে অতিরিক্ত রুম থাকলে অনেকে চিন্তিত থাকেন, কিভাবে সাজাবেন। তারাও বেছে নিতে পারেন বিভাজন দোলনা। তবে বিভাজন দোলনাতে অবশ্যই আরামদায়ক কুশন থাকতে হবে।

দোলনা বেঞ্চ: এমন দোলনা সাধারণত পার্কের বেঞ্চ আকৃতির হয়ে থাকে এবং হেলান দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। ব্যতিক্রম কিছু খুঁজলে বেঞ্চ দোলনা বেছে নেওয়া যেতে পারে। দেশে এইসব দোলনার প্রচলন খুব একটা নেই। দোলনা বেঞ্চ সাধারণত ভারতে দেখা যায়। এটি রাখতে খুব একটা জায়গার প্রয়োজন হয় না।

লোহার দোলনা: বাড়ির ছাদে লোহার দোলনা রাখতে পারেন। কারণ লোহার দোলনা সাধারণত বড় হয়ে থাকে। এতে দুই থেকে তিনজন বসতে পারে। বাড়ির ছাদের দোলনা রোদ পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে। ছাদের জায়গা বেশি থাকবার কারণে বড় দোলনাই বেছে নেওয়া উচিত। কারণ ছাদে সাধারণত মানুষ পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সাথে ভালো সময় কাটাতে যায়। যাতে করে দুই/তিন জন একসাথে বসতে পারে এমন ব্যবস্থা রাখা উচিত।

কোথায় পাবেন দোলনা

গৃহসজ্জায় জনপ্রিয় হবার কারণে দোলনা এখন সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, আজিজ সুপার মার্কেট, গুলশান সহ যেকোনো স্থানে দোলনা পাওয়া যায়। অনলাইনেও পাট ও বেতের দোলনা বিক্রি হয়ে থাকে। পুরান ঢাকাতেও রয়েছে বেশ কিছু দোলনার দোকান। এছাড়া অনেকেই নিজের পছন্দমতো কাঠ ও ডিজাইন দিয়ে দোলনা কাস্টমাইজড করে বানিয়ে নিতে চান। সেক্ষেত্রে ফার্নিচার দোকানে যোগাযোগ করতে হবে। তারা কাস্টমাইজড দোলনার অর্ডার নিয়ে থাকে। সাধারণত পাট ও বেতের দোলনা সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়। বাকি সব দোলনার দাম নির্ভর করছে মান ও ডিজাইনের উপর।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টেরিয়র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

six − 4 =