চলচ্চিত্র সম্পাদক সিমিত রায় অন্তর

ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমান সময়ে যারা চলচ্চিত্র সম্পাদনা করছেন তাদের মধ্যে সিমিত রায় অন্তরের নাম থাকবে প্রথম সারিতে। চলচ্চিত্র সম্পাদক হিসেবে গত চার বছরে তার ঝুড়িতে রয়েছে অনেক ভালো কাজ। বড় পর্দার পাশাপাশি সমানতালে কাজ করেছেন ওটিটি প্লাটফর্মেও। অবশ্য শোবিজ অঙ্গনে তার ক্যারিয়ার শুরু হয় নির্মাতা হিসেবে। ২০১২ সালে প্রথম নির্মাণ করেন ‘দোসর’ নামের টেলিছবি। চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখিও করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বর্তমানে ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু জুড়েই সম্পাদনা। সিমিত রায় অন্তরের সম্পাদিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘পরাণ’ সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ৪৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আয়োজনে পুরস্কার অর্জন করে। এবারের ঈদে তার সম্পাদনায় মুক্তি পাচ্ছে ‘দেয়ালের দেশ’ সিনেমা। তার সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

চলচ্চিত্র সম্পাদনা চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত কৌশল। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় চিত্র ও শব্দগ্রহণ সম্পূর্ণ হবার পর তা যথাযথভাবে সম্পাদনা করে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি হয়। সিনেমা নির্মাণের পোস্ট প্রোডাকশন প্রক্রিয়ার সৃজনশীল ও ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর অংশ হলো সম্পাদনা। এটি একটি শিল্প মাধ্যম। সম্পাদকের দক্ষতার ফলে যেকোনো সিনেমা কিংবা ফিকশন প্রাণ পায়। একজন ফিল্ম এডিটর যিনি সিনেমার সকল ফুটেজ কাটাকুটি করে জোড়া দিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ সিনেমা তৈরি করেন। সিমিত রায় অন্তর দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রের এই মাধ্যমে। নিজের মেধা ও পরিশ্রমের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পেয়েছেন সফলতাও।

যাত্রা শুরু

২০০০ সালের দিকে হানিফ সংকেত একুশে টিভিতে ‘কিঞ্চিৎ’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করতেন। সেই অনুষ্ঠানে একদিন ১ মিনিটের কম দৈর্ঘ্যরে ভিডিও চাওয়া হয়। তারপর নানা ধাপে নির্বাচন করে তিনটি ভিডিও প্রচার করা হয়। তারমধ্যে একটা ছিল সিমিত রায় অন্তরের। তারপর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন লম্বা একটা সময়। গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখায় মনোনিবেশ করেন। ২০১০ সালে দেশ টিভিতে একটা শর্ট ফিল্ম প্রতিযোগিতা হয়। দেশ টিভি এবং ওয়াটার এইড যৌথভাবে এটি আয়োজন করেছিল। সেখানে অংশগ্রহণ করেও বিজয়ী হয়ে যায় তার বানানো পাঁচ মিনিট দৈর্ঘ্যরে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। এটা নির্বাচিত হওয়ার পর নির্মাতা হওয়ার ঝোঁক চাপে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিনেমাকেন্দ্রীক বেশকিছু গ্রুপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। সিমিত রায় অন্তর কোনো সিনেমা দেখার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো জুড়ে দিতেন। সিনেমার ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করতেন। সিনেমা দেখে নিজের কথাগুলো জানানোর জন্য গ্রুপগুলোতে লেখালেখি করতেন। তিনি চেয়েছিলেন অভিনেতা হতে কিন্তু হয়ে গেলেন পরিচালক। টিভি নাটক পরিচালনা করতে গিয়ে পড়েছেন নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায়। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নির্মাণ করেছেন নাটক। চারটি নাটক নির্মাণ করার পর উপলব্ধি করলেন, তিনি এখানে সংগ্রাম করে বোধহয় টিকে থাকতে পারবেন না। চলচ্চিত্র সম্পাদনা করতে এসেছেন অনেকটা পেটের টানে। তিনি নিজের নির্মিত নাটকের পরিচালনা করার পাশাপাশি সম্পাদনাও করতেন। পাশাপাশি পরিচিতদের অনুরোধে মাঝেমধ্যে কাজ করতেন সম্পাদনার। একসময় দেখলেন নিজের সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন সিদ্ধান্ত নিলেন সম্পাদনা করেই সামনের দিনগুলো কাটাবেন। তারপর কেটে গেছে প্রায় এক দশকের বেশি সময়।

টেলিছবি নির্মাণ

সিমিত রায় অন্তর এখন অব্দি চারটি নাটক নির্মাণ করেছেন। ২০১২ সালে ‘দোসর’ নামের টেলিছবি নির্মাণ করেন তিনি। টেলিছবিটি প্রচারিত হয় মাছরাঙা টিভির পর্দায়। এতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় মুখ মেহজাবীন চৌধুরী। টেলিছবিটি পরিচালনা করার পাশাপাশি চিত্রনাট্য ও সম্পাদনাও করেছিলেন সিমিত রায় অন্তর। দুইশ বছর পূর্বের গল্প নিয়ে টেলিছবিটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথা ছিল সেসময়ের একটা গল্প তুলে ধরেছিলেন এক ঘণ্টা দৈর্ঘ্যরে টেলিছবিতে। গ্রাম্য সমাজে একটা মেয়ে একা জীবনযাপন করা নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন নিজের দ্বিতীয় টেলিছবি ‘উঠান’। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তাকে ঘিরে টেলিছবির গল্প। ‘হারমনি’ নামে একটি টেলিছবি নির্মাণ করেছিলেন বরেণ্য নাট্যকার বৃন্দাবন দাসের লেখা গল্পে। টেলিছবিতে কাজ করেছিলেন একঝাঁক গুণী অভিনয় শিল্পী। তারা হলেন চঞ্চল চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, শাহনাজ খুশী, আল মনসুর। রিয়াজ ও শবনম ফারিয়াকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘প্রতিক্ষা’ নামের টেলিছবি। ঢাকার সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর পোশাককর্মী রেশমা বেগমকে উদ্ধারের  ঘটনা নিয়ে ‘সতেরো’ নামের সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। যদিও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়াও বেশকিছু নির্মাণে হাত দিলেও তা আর চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছাতে পারেনি।

বড় পর্দায় কাজ

সিমিত রায় অন্তর বড় পর্দায় বেশকিছু কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। রায়হান রাফির ‘পরাণ’ সিনেমায় তার সম্পাদনা মুগ্ধ করেছিল  দর্শকদের। রায়হান রাফির সঙ্গে ‘দামাল’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। আফরান নিশোর ‘সুড়ঙ্গ’ রীতমতো ঝড় তুলেছিল দর্শক মহলে। সে অর্জনের অংশীদার সিমিত রায় অন্তর। রায়হান রাফির সঙ্গে ‘নূর’ সিনেমায় কাজ করেছেন যা মুক্তির অপেক্ষায়। শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমায় যুক্ত ছিলেন এই মেধাবী সম্পাদক। দীপংকর দীপনের ‘অন্তর্জাল’ সিনেমা সম্পাদনা করেছেন তিনি। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বঙ্গমাতা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সিমিত রায় অন্তর। লেখক খোরশেদ বাহারের ‘বঙ্গমাতা ইতিহাসের নিভৃত সৈনিক’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন নাসরীন মুস্তাফা ও চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন গৌতম কৈরী। এবারের ঈদে মুক্তি পাচ্ছে মিশুক মনির পরিচালিত ‘দেয়ালের দেশ’ সিনেমা। রাজ-বুবলী জুটির সিনেমাটা নিয়ে ইতিমধ্যে দর্শক মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হচ্ছে। সিনেমাটি সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।

ওটিটি প্লাটফর্মে কাজ

ওটিটি প্লাটফর্মে ডজনখানেক কাজে যুক্ত ছিলেন সিমিত রায় অন্তর। কাজ করেছেন গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে। নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন ভিন্নধর্মী গল্পে কাজ করার মাধ্যমে। যে কাজগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি – এইডা কপলা, দ্য বর্ডার, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, নেটওয়ার্কের বাইরে, জানোয়ার, ডার্ক সাইড অফ ঢাকা, জোয়ার ভাটা, তিথির অসুখ, সংসার, নিঃশ্বাস, ৭ নাম্বার ফ্লোর, টান, দাগ, উনিশ ২০, ফ্রাইডে। দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্মে মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কাজের মধ্যে একটি মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘নেটওয়ার্কের বাহিরে’ যা তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল, সে কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অন্তর। ‘টান’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’, ‘জানোয়ার’সহ রায়হান রাফীর ওটিটিতে প্রায় সব কাজের সম্পাদনা করেছেন তিনি।

বর্তমানে নির্মাতাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে যার ফলে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন একই নির্মাতাদের সঙ্গে। সিমিত রায় অন্তরের পছন্দের নির্মাতা সত্যজিৎ রায় এবং তারেক মাসুদ। সামনের দিনে আবারও ক্যামেরার পিছনে কাজ করতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। ব্যস্ততার কারণে সময় বের করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অদূর ভবিষ্যতে সিমিত রায় অন্তরের ইচ্ছা রয়েছে প্রতি বছর একটি করে বড় পরিসরের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার, যাতে নিজের মধ্যে থাকা পরিচালনার ক্ষুধাটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও মেটে। বর্তমানে চলচ্চিত্র সম্পাদনা মনোযোগ দিয়ে করতে চান তিনি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 4 =