চাঁদের দু পিঠ দেখলো বাংলাদেশ

সালেক সুফী: ১ জানুয়ারী থেকে ১১ জানুয়ারী ২০২২। টাইগার বাহিনী বছরের প্রথম ১০ দিনেই চাঁদের দুই দিক দেখে ফেলেছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বে ওভালে অপ্রত্যাশিত জয়ে ছিল পূর্ণিমার ভরা জোৎস্না।  হ্যাগলি ওভালে বিশাল পরাজয়ে তেমনি দেখা হলো অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিস্মিত হতে হয় বিশ্ব টেস্ট অঙ্গনের বামুনদের কাছেই প্রথম টেস্টে ৮ উইকেটে হেরেছিল টেস্ট অঙ্গনের অভিজাত দল।  বাংলাদেশ দলে বিশ্বমানের তামিম, সাকিব, রিয়াদ ছিল না। মূলত অধিকাংশ নবীন খেলোয়াড় নিয়ে বাংলাদেশের দাপুটে জয় ( দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে নিউজিলান্ডে ৩১ ম্যাচ পরে প্রথম) ক্রিকেট বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল।  পরাজয়ে  নিশ্চিতভাবে বিশ্বচ্যাম্পিনদের আঁতে ঘা লেগেছিলো। সিংহবিক্রমে ওদের ঘুরে দাঁড়ানো প্রত্যাশিত ছিল। তারপর খেলাটি ছিল হ্যাগলি ওভাল নিউজিল্যান্ডের দুর্গম দুর্গে। কখনো কোনো দলই ওদের এই মাঠে হারাতে পারেনি। সবুজ ঘাসে ভরা পেসি, বাউন্সি উইকেট।  বাংলাদেশের কালেভদ্রে এখানে খেলার সুযোগ হয়। এমনিতেই স্বল্প অভিজ্ঞতা, তারপর প্রতিশোধ নেশায় মত্ত ব্ল্যাক ক্যাপসরা। তিন দিনেই ইনিংস এবং ১১৭ রানের বিশাল ব্যাবধানে জয় করলো টেস্ট। সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ হলো। বাংলাদেশের বিশাল ব্যাবধানে পরাজয়ে অনুরাগীরা কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু এই ধরনের উইকেটে বিশ্বমানের একটি দলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইনিংসে যতটুকু লড়াই করেছে তরুণ দলের জন্য সেটিও কম অর্জন বলবো না।

প্রথম টেস্টের সাহসী ব্যাটসম্যান মাহমুদুল হাসান জয় আহত হয়ে ছিটকে পড়েছিল। তারপর খেলা শুরুর আগে জানা গেলো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সেরা ৫ জন আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের শেষ প্রতিনিধি মুশফিকুর রাহিম আহত থাকায় খেলতে পারেনি। মোহাম্মদ  নাঈমের অভিষেক হলো, মুশফিকের স্থানে নেয়া হলো নুরুল হাসান সোহানকে। অন্যদিকে উইকেটের চরি্ত্রের কথা বিবেচনা করে নিউজিলান্ড চার জন বিশ্বমানের পেস বোলারের সঙ্গে মিচেলকে  অন্তর্ভুক্ত করলো।

সবাই এমনভাবে হ্যাগলি ওভাল নিয়ে হাইপ সৃষ্টি করলো যেন বাংলাদেশকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিবে ওরা। হয়তো বাংলাদেশ দল একটু হকচকিয়ে ছিল।বে ওভালের মতো হ্যাগলি অভ্যালেও টস জয় করলো বাংলাদেশ। তবে সবুজ ঘাসের উইকেটে মেঘে ঢাকা স্বয়ং সহায়ক উইকেটের ফায়দা নিতে পারলো না বাংলাদেশ। এই ধরনের উইকেটে সঠিক লেংথ বা লাইন বজায় রাখার অভিজ্ঞতা কম থাকায় এবং কিছুটা ফিল্ডিং শিথিলতার পুরাপুরি ফায়েদা তুলেছে লাথাম,  কোনওয়ে।  অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে ভাগ্য সহায় ছিল না, অন্তত দুইবার আম্পায়ারর্স কল  বিবেচনায় বেঁচে  যায় লাথাম। অবশ্য  ইয়ং (৫৪), কোনওয়ে (১০৯), লাথামের (২৫২) অতিমানবীয় ব্যাটিং বাংলাদেশের মনোবল দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিলো। ৫২১/৬ বিশাল স্কোর দেখে হয়তো হয়তো বিহ্বল হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ।

সৌদি, বোল্ট, ওয়াগনার, জেমাইসন এই ধরনের উইকেটে বিশ্বসেরা।  তারপর বিশাল রানের কুশন। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো বাংলাদেশ। ২৯/৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ যখন সর্বনিম্ন স্কোরের বিড়ম্বনায় বিচলিত ইয়াসির আলী এবং নুরুল সোহান দেয়ালে পিঠ রেখে লড়াই করলো। তার পরেও ১২৬ রান করে গুটিয়ে গেলো বাংলাদেশ দ্বিতীয় দিনের অন্তিমলগ্নে। বোল্ট ৫/৪৩ নিয়ে ৩০০ টেস্ট উইকেটের কুলীন ক্লাবে নাম লেখালো।

তৃতীয় সকালে হ্যাগলি ওভাল মাঠের সবচেয়ে ব্যাটিং উপযোগী পরিবেশে ৩৯৫ রান পিছিয়ে থেকে শুরু করলো বাংলাদেশ। বলতেই হবে নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েই লড়াই করেছে বাংলাদেশ। সাদমান, নাঈম, শান্ত, মোমিনুল সবাই ভালো সূচনা করেও ওয়াগনার, জামাইসনের আগ্রাসী বোলিংয়ের সামনে ইনিংস বড় করতে পারেনি। কিন্তু দর্শনীয় ব্যাটিং করেছে লিটন দাস।  সঙ্গী ছিল নুরুল সোহান।  ওদের যোগাযোগে ১০১ রান যোগ হওয়ায় বাংলাদেশ খেলাটি চতুর্থ দিনে টেনে নেয়ার স্বপ্ন দেখার সময় সোহান ৩৬ রানে আউট হয়ে যায়। লিটনের ১১৪ বলে ১০২ রান বাংলাদেশের পরাজয়েও হীরকখন্ড হয়ে জ্বলছে। বিশ্বমানের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এই ইনিংসটি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটিং বলে বিবেচনায় আসবে। যাক সেই কথা, মাত্র তিন দিনে ইনিংস এবং ১১৭ রানের ব্যাবধানে  পরাজয় থেকেও অনেক কিছুই শেখার আছে। বাংলাদেশ দেশের উইকেট গুলো যতদিন স্পোর্টিং উইকেটে রূপান্তর না করতে পারবে, ততদিন বিশ্বমানের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে হয়তো কালেভদ্রে জয় পাবে।  এমনি একটি জয়ের সুবাদে ১-১ সিরিজ শেষ করাও কম অর্জন নয়।একটি বিশাল জয় আর তারপর পিঠে লজ্জাজনক ইনিংস পরাজয়। একেই বলে চাঁদের দুই পিট দেখা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen + two =