গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
সংগীতের অনেক ধরনের ধরন রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে র্যাপ সংগীত। উপমহাদেশে গানের এই ধারাটি বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নতুন করে আলোচনায় এসেছে র্যাপ সংগীত। র্যাপ হিপহপ সংস্কৃতির একটি অংশ। নিউ ইয়র্কের ব্রংকস এলাকা থেকে ১৯৭০-এর শেষভাগে জোয়ার আসে হিপহপের। তারপর মার্কিন মুলুক ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকেই র্যাপ গান চলছে। র্যাপ সংগীতকে বলা হয় প্রতিবাদের ভাষা। অনিয়মের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয় গানের মাধ্যমে। এবারের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেক বাংলাদেশি র্যাপার প্রতিবাদ করেছে নিজেদের কথা আর কণ্ঠস্বর দিয়ে। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনে র্যাপারদের ভূমিকা তুচ্ছ করার সুযোগ নেই। নতুন প্রজন্মের র্যাপারদের মাধ্যমে প্রায় ৩০টির মতো র্যাপ গান প্রকাশিত হয় ছাত্রদের এই আন্দোলন নিয়ে। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গান দিয়ে প্রতিবাদ করা কয়েকজন র্যাপার সম্পর্কে জানবো আমরা এবারের আয়োজনে।
‘আওয়াজ উডা’র স্রষ্টা হান্নান
আওয়াজ উডা বাংলাদেশ, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ
রাস্তায় এত রক্ত কাগো, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ
আমরা বলে রাজাকার কয় দি দেশের রাজাকার
ছাত্র আওয়াজ না উডাইলে দেশের ভিত্তে হাহাকার
গদিত বইসে স্বৈরাচার কত কিছু শইয়া আর
তর পজিশন টিক্কা থাকবো কত ভাই ক মইরা আর
নামসি বুকে পতাকা দেশ বেচতাসোস কয় টেকা
সিলেট যহন ডুইব্বা গেসে পানি আইসে কইথেকা
আবু সাঈদরে গুল্লি করলি অডার দিলো কইথেকা
এবার রাস্তায় লাখো সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!
এটি র্যাপার হান্নানের ‘আওয়াজ উডা’ শিরোনামের গানের কথা। হান্নান হোসাইন শিমুল সকলের কাছে র্যাপার হান্নান নামে পরিচিত। তার জন্ম জুরাইনে, বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। পড়াশোনা করেছেন জুরাইন ও নারায়ণগঞ্জে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। র্যাপ সংগীতে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। প্রথম গান ‘ডিসকাউন্ট’ মুক্তির পর সকলের নজরে আসেন তিনি। ৬ বছর ধরে নিয়মিত র্যাপের সঙ্গেই আছেন হান্নান। একাধিক মিক্সড অ্যালবাম করেছেন তিনি। এবারের আন্দোলনে ‘আওয়াজ উডা’ গান গেয়ে সকলের মনে ধাক্কা দিয়েছিলেন এই তরুণ র্যাপার। ১৭ জুলাই দুপুরে গান লেখা শেষ করে, রাতেই রেকর্ড করে পরদিন ১৮ জুলাই ইউটিউবে প্রকাশ করে গানটি। বিপ্লবী এই গান করে সাজার মুখে পড়তে হয়েছে হান্নানকে। ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড় এলাকা থেকে হান্নানকে গ্রেপ্তার করে ফতুল্লা থানা-পুলিশ। আদালতে নেওয়ার আগে থানায় ৩৯ ঘণ্টা রাখা হয়েছিল তাকে। হান্নানের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ করেন শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। ১৩ দিন কারাগারে থাকার পর ৬ আগস্ট মুক্ত হন হান্নান। কারাগারে থাকতেই একটি গান লেখেন যা বের হয়ে প্রকাশ করবেন পরিকল্পনা করেছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে ৭ আগস্ট ‘রিস্ক’ শিরোনামের গানটি প্রকাশ করেন। কারাজীবন নিয়েও একটা গান লিখেছেন তিনি, মাসখানেকের মধ্যে গানটা প্রকাশ করবেন। নিজের একক অ্যালবাম ‘হরেক মাল’ নিয়ে কাজ করছেন যেখানে ৯টি গান থাকবে। বিগত দুই বছর ধরে গানকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন তিনি।
‘কথা ক’ গানের কারিগর সেজান
’৫২-র তে ’২৪-এ তফাত কই রে কথা ক!
দ্যাশটা বোলে স্বাধীন, তাইলে খ্যাচটা কই রে কথা ক!
আমার ভাই-বইন মরে রাস্তায়, তর চেষ্টা কই রে কথা ক!
কালসাপ ধরসে গলা পেঁচায়; বাইর কর সাপের মাথা কো
এই, জোর যার মুল্লুক তার! আগে ক মুল্লুক কার
লাঠির জোরে কলম ভাঙে, শান্তির নামে তুলল খাঁড়
কাইল মারলি, পরশু মারলি, মারতে আইলি আজ আবার!
রাজায় যহন প্রজার জান লয়, জিগা তাইলে রাজা কার
আমার মানচিত্র কান্দে আইজকা দেইখ্যা দ্যাশের হাল রে
লাল-সবুজের পতাকা, মা, পুরাডাই দেহি লাল রে
তলোয়ার হইয়া কাটে – যাগোর হওয়ার কথা ঢাল রে
পাপের জিহ্বায় সইতারে না উচিত কথার ঝাল রে
র্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ গানের কথা। নারায়ণগঞ্জ জেলায় বেড়ে ওঠা মুহাম্মদ সেজানের। ২০১৮ সালে সেজানের প্রথম গান ‘সাইড ল’ প্রকাশ পায়। বাংলা হিপহপ গানে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করেছেন মুহাম্মদ সেজান। নিজের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নিয়মিত গান প্রকাশ করেন এই শিল্পী। এবারের আন্দোলনে মুহাম্মদ সেজানের ‘কথা ক’ শিরোনামের গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। নিজের জেদ থেকেই তিনি লিখেছিলেন ‘কথা ক’ শিরোনামের গান। র্যাপার সেজানের মতে, যেকোনো মানুষের দাবি থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে যদি অত্যাচার করা হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়। সেই জেদ থেকেই গানটি লিখেছিলেন তিনি। ১৬ জুলাই ‘কথা ক’ শিরোনামের গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে যায়। র্যাপার হান্নানের মতো কারাগারে যেতে না হলেও বিভিন্ন মহল থেকে চাপের মুখে পড়েছিলেন সেজান। আন্দোলনের উত্তাল সময়ে সবার আগে ‘কথা ক’ গান দিয়ে তিনিই সাড়া জাগিয়েছিলেন র্যাপার সেজান। এখন অব্দি ৫০টি গান প্রকাশ করেছেন তিনি।
শুধু সেজানের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলেই গানটির ভিউ ছাড়িয়েছে ৯০ লাখ। এ ছাড়া আরো বহু পেজে গানটি শেয়ার হয়েছে। সেজানের কথা, সুর ও সংগীতে গানটির মিক্স-মাস্টার করেছে স্নেয়ারবিট। গানটা প্রকাশের পর বাংলাদেশে ইউটিউবের মিউজিক ট্রেন্ডিংয়ের প্রথম স্থানে ছিল গানটি। সামনে নতুন গান নিয়ে হাজির হবেন তিনি।
এমসিসি ই ম্যাক-জিকে কিবরিয়ার ‘ইনকিলাব’
মইরা যামু কি হইছে
কইয়া যামু কি হইছে
১৬ বছর কি হইছে
আর স্বাধীনতার কি হইছে
কি হইছে আর কি হইবো
ভবিষ্যতের কি হইবো
এতো লাশের কি হইবো
আর দাবি গুলার কি হইবো
মইরা যামু কি হইছে
কইয়া যামু কি হইছে
১৬ বছর কি হইছে
আর স্বাধীনতার কি হইছে
এভাবেই কলম হাতে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এমসিসি-ই ম্যাক এবং জিকে কিবরিয়া। ২০১১ সালে হিপহপ জগতে আসেন এমসিসি-ই-ম্যাক। ফেনী থেকে উঠে আসা এই শিল্পী নিজের ভালো লাগা থেকে গান করেন। এখন পর্যন্ত তার ইউটিউব চ্যানেলে পঞ্চাশের অধিক গান প্রকাশিত হয়। এমসিসি ই ম্যাক শুধু একাই গান করেন তা নয়, তার সকল গানের সাথে যুক্ত আছেন তার বন্ধু জিকে কিবরিয়া। গান গাওয়ার পাশাপাশি এমসিসি ই ম্যাক গানগুলোকে কম্পোজিং ও মিক্সিং-মাস্টারিং করেন, অন্যদিকে জিকে কিবরিয়া গানগুলো লিখে থাকেন। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে প্রতিবাদ হিসেবে ৩১ জুলাই ইনকিলাব নামক গান রিলিজ করেন। এখন পর্যন্ত গানটি ৪ লক্ষাধিক মানুষ শুনেছেন। গানটিতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের হত্যা, গুম করা কেন হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন চেয়েছিলেন গানের মাধ্যমে।
কিউএমজি অরজিনালস এর ‘চব্বিশের গেরিলা’
জবাব চাই আমার ভাই মরলো ক্যান ক
জবাব চাই আমার আমার রক্ত ঝরলো ক্যান ক
জবাব চাই কলম হাতে অস্ত্র ক্যান ক
জবাব চাই আমার জবাব নাই ক্যান ক
আমি কে তুমি কে
রাজাকার, রাজাকার।
কে বলেছে কে বলেছে
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার
কোটা আন্দোলনের সহিংসতাকে ঘিরে এভাবেই প্রতিবাদ করেছিলো কিউএমজি অরজিনালস। ছয়জন র্যাপারের সমন্বয়ে গানটি তৈরি হয়েছিলো। গানটি লিখেছিলেন ও র্যাপ করেছিলেন ক্রিটিকাল মাহমুদ, সম্রাটসিজ, সুটার ৪৭, রিমনডিমন এবং সাফায়েত জিসান। ৩০ জুলাই গানটি কিউএমজি অরজিনালস এর ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পায়। তারা সকলেই জীবন বাজি রেখে গানটি গেয়েছিলেন এবং গান প্রকাশিত হওয়ার পর আত্নগোপনে চলে গিয়েছিলেন। গানটি এখন পর্যন্ত ১৭ লক্ষ বার শোনা হয়েছে। গানটির সংগীত আয়োজন এবং প্রযোজনা করেন সামি তন্ময়। এছাড়াও গানটি মিক্সিং ও মাস্টারিং করেন ক্রিটিকাল মাহমুদ।
‘রক্ত’ গান নিয়ে এস অমিক্স
সালাম রফিক জব্বার আইজ বাংলাদেশ ও দরকার
ভাই মরে, বইন মরে, চুপ খেনে সরখার
রক্তে ভাসের নগর ছাইছি খরি আমার অধিকার
রাজা খার যে ফাউ ছাটে তুমি তার।
শিক্ষিত দেশ ছাইলে ছাত্র মরে খেনে
ড্রেইন ও কিতা ব্রেইন নি না ড্রেইন ব্রেইন ওর মাজে
এভাবেই কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সিলেটের একদল তরুণ র্যাপের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। এস অমিক্স ইউটিউব চ্যানেল থেকে রক্ত নামক গানটি প্রকাশিত হয়। গানটি লিখেছিলেন এবং গেয়েছিলেন এস অমিক্স, মাহি১রিয়াল, আতঙ্গ ক মিউজিক, ইয়ানিশারুখ, বিদ্রোহ দ্যা ওজি। ২৬ জুলাই মুক্তিপ্রাপ্ত গানটি এখন পর্যন্ত সাত লক্ষের অধিক শোনা হয়েছে। গানটিতে আন্দোলনে শহিদ হওয়ার সকলের প্রতি উৎসর্গ এবং হামলাকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। গানটি প্রযোজনা এবং কম্পোজ করেন এস অমিক্স।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে