‘জলবায়ু চ্যাম্পিয়ন’ তৃণমূলের নারীদের স্বীকৃতি দিল মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমে অসাধারণ অবদানের জন্য ১০ জন তৃণমূল নারী জলবায়ু নেত্রীকে সম্মাননা জানিয়ে ‘ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫’- প্রদান করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।
আজ বুধবার ঢাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে (আলোকি) দেশব্যাপী নারী নেতৃত্বাধীন ১০০টি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও)-এর অংশগ্রহণে অ্যানুয়াল কমিউনিটি অব প্র্যাকটিসেস (CoP) নেটওয়ার্ক কনভেনশন ২০২৫ – অনুষ্ঠিত হয়।

তৃণমূল পর্যায়ের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন উদ্যোগ উপস্থাপনের এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়ে ওঠে এই নেটওয়ার্কটি, যা জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত এবং ইউএন উইমেন বাংলাদেশের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত “এমপাওয়ার: উইমেন ফর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট সোসাইটিজ (২য় ফেইজ)” প্রকল্পের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে তিনি অনুরোধ জানান, তাঁকে নয়, বরং তৃণমূলের নারী জলবায়ু নেত্রীদের প্রধান অতিথি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। তিনি বলেন, এই অনুষ্ঠানে এসে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরগুলো এখানে অংশগ্রহণ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের উন্নয়নের দর্শন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। বড় বড় মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি নদীভাঙন ও দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন প্রতিটি প্রান্তিক মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে। মাইক্রো লেভেলে সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ম্যাক্রো লেভেলে উন্নয়নের দর্শনও বদলাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিযোজন উদ্যোগগুলোকে বড় আকারে সম্প্রসারণ করতে হবে। স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনীগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।

বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বলেন, এমপাওয়ার প্রকল্প আমাদের জেন্ডার সমতা ও জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রতি গভীর অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এই দুটি লক্ষ্য একে অপরের পরিপূরক এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আমরা বিশ্বাস করি, নারীরাই জলবায়ু কর্মকাণ্ডের আরও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রদানকারী। আপনারাই উদ্ভাবন করছেন, সংগঠিত করছেন এবং সম্প্রদায়ে পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইউএন উইমেন ও ইউএনইপি-র অংশীদারিত্বে সুইডেন গর্বিতভাবে এমপাওয়ার প্রকল্পকে সমর্থন করছে।

সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সহযোগিতা প্রধান দীপক এলমার বলেন, বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অনুদান কমছে, জলবায়ু প্রভাব বাড়ছে, বৈষম্য বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ -বিশেষ করে নারীরা ও মাঠপর্যায়ের নেত্রীরা তা প্রমাণ করে চলেছেন। নেতৃত্ব সবসময় ওপর থেকে আসে না; আসে তাদের কাছ থেকে যারা কাজ করে, অভিযোজন করে এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। এই কারণেই সুইজারল্যান্ড বিশ্বাস করে কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন উন্নয়নে। কারণ, প্রান্তিক পর্যায় থেকে তৈরি করা সহনশীলতাই ভবিষ্যতে স্থায়ী হয়।

ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলী সিং বলেন, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও কমিউনিটি রেজিলিয়েন্সে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক নেতৃত্বের উদাহরণ। এই উদাহরণটিকে আরও অসাধারণ করে তুলেছে বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ের নারীদের নেতৃত্ব, যারা জলবায়ু ঝুঁকিকে পরিবর্তনের সুযোগে পরিণত করছেন। ইউএন উইমেন – বাংলাদেশের সরকার, এমজেএফ ও অংশীদারদের সঙ্গে মিলে জলবায়ু-সহনশীল ও জেন্ডার সমতাভিত্তিক ভবিষ্যৎ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

ইউএন উইমেনের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট দিলরুবা হায়দার বলেন, ২০১৮ সাল থেকে আমরা এমপাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা নারীর জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাই। যার মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হবে এবং তারা স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে পারবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, নারীরাই তাঁদের সম্প্রদায়ের প্রকৃত সহনশীলতার চালিকা শক্তি। তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নেতৃত্বকে প্রসারিত করা টেকসই ও জলবায়ু-নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
তিনি জেন্ডার-রেসপন্সিভ নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরাই জলবায়ু সংকটের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন।”

ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট কাজী রাবেয়া এমি এবং এমজেএফ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাসরিন আহমেদ এমপাওয়ার প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মাঠপর্যায়ের উদ্ভাবনী উদ্যোগের প্রদর্শনীসহ দশটি স্টল সাজানো হয়। এছাড়া তিনটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়, যা পরিচালনা করেন যথাক্রমে সাবরিনা নওরিন, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, সিইডি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি; মো. শামসুদ্দোহা, চিফ এক্সিকিউটিভ, সিপিআরডি এবং সোমা দত্ত, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, এমজেএফ। সেশনগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল – নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ফাইন্যান্সিং, নীতি, বাস্তবতা ও ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান (CCGAP), এবং উইমেন’স লিডারশিপ ইন কালেকটিভ ক্লাইমেট অ্যাকশনস।

জাতীয় পর্যায়ের এই সম্মেলনের মাধ্যমে এমজেএফ পুনরায় দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে নারীর নেতৃত্ব, স্থানীয় অভিযোজন এবং জলবায়ু ন্যায়বিচার এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সম্মেলন শেষে এক যৌথ অঙ্গীকারের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের কর্মী ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করা হয় – যাতে বাংলাদেশের জলবায়ু সহনশীলতার যাত্রার কেন্দ্রে থাকে নারী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × five =