জলবায়ু দরকষাকষির নতুন শুরু

মোল্লাহ আমজাদ হোসেন, আফরোজা আখতার পারভীন ও আদিত্য হোসেন

দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে

সম্প্রতি শেষ হলো জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৮। দুবাইতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন শেষ হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য ১৯৮ দেশের সমন্বিত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর শেষ হওয়া এই সম্মেলনে ২৮ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো। অনেকে মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কয়লা, তেল ও গ্যাস যুগের সমাপ্তির সূচনা হলো। এর মাধ্যমে সূচিত হবে একটি নবযুগের, কমে আসবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা, টেকসই উন্নয়ন অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঘোষণায় বলা হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রত্যেক দেশকে সক্ষমতা অনুসারে ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার তিন গুণ এবং জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার দ্বিগুণ করা যায়। দুবাই সম্মেলনের এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে বিগত এক বছরের নানামুখী প্রচেষ্টা ও দরকষাকষির মধ্য দিয়ে। তবে এই সম্মত সিদ্ধান্তগুলোর পরিণতি নির্ভর করবে জলবায়ু তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগানের উপর। যা মূলত উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।

সমাপনী বক্তব্যে কপ২৮ প্রেসিডেন্ট ড. সুলতান আল জাবের বলেন, ‘আমরা একটি নতুন ধ্রুবতারার সন্ধান পেয়েছি। বিশ্বকে এই নক্ষত্র অনুসরণ করে নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে। আমাদের এই গ্রহ এবং তার বাসিন্দাদের উন্নত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। এই ঐতিহাসিক সাফল্যে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত।’ তবে তার সভাপতিত্ব যথেষ্ট সমালোচনার খোরাকও যুগিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত কপ২৮ সম্মেলনকে তেল এবং গ্যাস বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য ব্যবহার করেছে। জাতিসংঘ অবশ্য বলছে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পর জলবায়ু ইস্যুতে এই ঘোষণা ছিল মানবজাতির সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ।

এই দশকের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধে কোনো নির্দেশনা না থাকায় অনেক দেশই আলোচনা থেকে বের হয়ে এসেছিল। বলা হচ্ছে, বেশকিছু ফাঁক-ফোঁকর থাকায় এই ঘোষণার প্রভাবে বরং তেল, গ্যাস এবং কয়লার উৎপাদন এবং ব্যবহারে উলম্ফন হতে পারে। সম্মেলনের শুরুতেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনের মতো বড় ঘটেনা ঘটছে। তবে স্পষ্ট আর্থিক প্রতিশ্রুতি না থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

 

সম্মেলনের শুরু থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার একটি শক্তিশালী খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করে। প্রস্তাবের পক্ষে সরব ছিল জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশ ও সিভিল সোসাইটি। কিন্তু তা ঐতিহাসিক দূষণকারী ও জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশগুলোর প্রচণ্ড বিরোধের মুখে পড়ে। তবে জাবেরের তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টায় এই অচলাবস্থা কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি। জাবের প্রাথমিক প্রস্তাবে অধিকাংশ দেশগুলোর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর আশাবাদী হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত, চূড়ান্ত ঘোষণা পুরেপুরি প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। এই চুক্তিতে দেশগুলোকে শুধু জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু কতদিনের মধ্যে আর কী কৌশলে তা অর্জন করতে হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি।

তবে, দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর একজন প্রতিনিধি অভিযোগ করেন, তাদের অনুপস্থিতিতে সম্মেলনের সভাপতি এমন ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন, চূড়ান্ত ঘোষণাটি নানা ফাঁক-ফোঁকর এবং ভ্রান্তিতে ভরা। জলবায়ু আন্দোলনের পক্ষে থাকা গ্রুপগুলোও বলছে, এই ঘোষণা জলবায়ুর জরুরি অভিঘাত মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। গ্রিনপিস বলছে এই ঘোষণার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রক্রিয়া গতিশীল হবে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

তবে বৈশ্বিক সম্মেলনে দুবাইয়ে প্রায় ২০০টি দেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় একটি গ্লোবাল স্টেকটেক (জিএসটি) সম্পন্ন করতে সফল হয়েছে। জিএসটির প্রধান লক্ষ্যই হলো, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখা।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নির্বাহী সম্পাদক সিমন স্টিয়েল বলেন, ‘যদিও দুবাইতে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের অবসানে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হইনি, তবুও আমাদের ঘোষণার মাধ্যমে সূচনা হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া। এখন সরকার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হলো এসব প্রতিশ্রুতিকে সত্যিকারের কাজে পরিণত করা, কোনো সময় ক্ষেপণ ছাড়াই।’

সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ। তারা এখানে নিজেদের পরিকল্পনা এবং সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন, গঠন করেন অংশীদারিত্ব এবং বিভিন্ন জোট। বিশ্বনেতারা ছাড়াও এতে অংশ নেন সিভিল সোসাইটি, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আদিবাসীরা, তরুণ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন নাগরিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।

সম্মেলনের প্রধান সাফল্য মনে করা হচ্ছে জিএসটিকে। কারণ এর মধ্যেই রয়েছে আলোচনায় থাকা বিষয়গুলো, যার মাধ্যমে দেশগুলো ২০২৫ সালের মধ্যে শক্তিশালী জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে জিএসটি। এখানে বলা হয়েছে, সকল দেশই প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। জিএসটি আরো বলছে, দেশসমূহকে বৈশ্বিক পর্যায়ে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০৩০ সালের মধ্যে তিন গুণ এবং জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার দ্বিগুণ করতে হবে। এতে আরো বলা হয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিমাণ কমিয়ে আনতে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অদক্ষ কেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার অন্যান্য উদ্যোগ সচল রাখতে হবে। এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব নিতে হবে।

জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আন্নালেনা বেয়ারবক বলেছেন, ‘এই ঘোষণা আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।’ তার মতে, এই ঘোষণা শুধুই একটি সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

কপ২৮ এর সূচনা হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট একশন দিবসের মাধ্যমে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন ১৫৪ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। যেখানে দেশগুলো সম্মেলনের প্রথম দিনেই ঐতিহাসিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের যাত্রা শুরু করতে সক্ষম হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্রই এই তহবিলে অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও আসতে থাকে। এখন পর্যন্ত এই তহবিলে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও লস অ্যান্ড ড্যামেজ এজেন্ডার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। যেখানে বলা হয়েছে স্যান্টিয়াগো নেটওয়ার্ক ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজেস সচিবালয় পরিচালনা করবে। এই সচিবালয় থেকে উন্নয়নশীল ও ঝুকিপূর্ণ দেশগুলোকে কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হবে।

নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম মুঞ্জুরুল হান্নান খান রঙবেরঙকে বলেন, ‘আমরা ৮০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি। কিন্তু বিশ্বব্যাংককে এই তহবিল পরিচালনায় চার বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি বড় ধরনের দ্বিধার সৃষ্টি করেছে।’

গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন এর ব্যাপারে সবগুলো পক্ষ একমত হয়েছে। এই ফ্রেম ওয়ার্ক-এর মধ্যে এডাপটেশন টার্গেট, অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডিং সাপোর্ট-এর প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেছেন, ‘জলবায়ু ঝুকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এডাপটেশন আসলেই একটি জীবন-মরণ সমস্যা। আমরা এ বিষয়ে কোনো আপোস করতে পারি না। … আমরা জীবন এবং জীবিকার বিষয়েও কোনো রকম আপোস করতে পারবো না।’

এবার আরো ছয়টি দেশ দ্য গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এ নতুন করে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ফলে ৩১টি দেশের কাছ থেকে রেকর্ড ১২.৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি এসেছে। এই তহবিলে আরো অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি আশা করা হচ্ছে। ৮টি স্বল্পোন্নত দেশের জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলে আরো ১৭৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি এসেছে। এবার এডাপটেশন তহবিলে প্রতিশ্রুতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার।

তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং এ বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে হাজার কোটি ডলার দরকার হবে তা থেকে এসব প্রতিশ্রুতি এখনো যোজন-যোজন দূরত্বে আছে। এই ধরনের তহবিলের জন্য বিশেষজ্ঞরা বহুপাক্ষিক আর্থিক অবকাঠামো নতুন করে গড়ে তোলা এবং বর্তমান অবকাঠামোকে আরো শক্তিশালীভাবে গতিশীল করার উপর জোর দিয়েছেন।

মিটিগেশন কর্মপরিকল্পনার আওতায় কার্বন মুক্ত করার প্রক্রিয়াকে চলমান রাখার জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বছরে কমপক্ষে দুটি সংলাপের আয়োজন করা হবে। এ বিষয়ে কপ২৮ থেকে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এসেছে। এই সম্মেলনে খাদ্য এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কিছু ঘোষণা এসেছে। এছাড়া কৃষিখাত এবং মিথেনের নিঃসরণ কমানো সংক্রান্ত ঘোষণাও এসেছে। এমন আরও অনেক কিছু আছে যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে আমরা কয়লা, তেল ও গ্যাস বিদ্যুতের বদলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দেখতে পাবো। যদি চীন এবং ভারত সবুজ জ্বালানি বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যায় তা হবে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার এক নতুন প্রাণসঞ্চারক। তবে এবারের ঘোষণায় মধ্যবর্তী জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালে ইউএনফসিসিসি সচিবালয়ে রেকর্ড ১১টি দেশ তাদের ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান জমা দিয়েছে। এই দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার সুস্পষ্ট করেছে। এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা প্রায়োগিক এবং নজরদারিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

বলা হচ্ছে এবারের ঘোষণার চারটি স্তম্ভ রয়েছে – জ্বালানির বাঁকবদলে দ্রুতগতি আনা, জলবায়ু তহবিলকে আরো বেশি সহজসাধ্য করা, মানুষ-প্রকৃতি-জীবন ও জীবিকার উপর মনোনিবেশ করা, এবং জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করা।

এবারের সম্মেলনে যে পর্যায়ে অ্যাকশন এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা কপের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি এবং অংশগ্রহণকারীদের সদিচ্ছা ও ইতিবাচক মনোভাবের ব্যাপক স্বাক্ষর রয়েছে। এবারের কপে মোট ৮৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এই সম্মেলনে ১১টি প্রতিশ্রুতি এবং ঘোষণা উপস্থাপিত হয়েছে।

কপ২৮ প্রেসিডেন্সি সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে তারা এই সম্মেলনে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলোর বাস্তব রূপরেখা দিতে কপ২৯ এবং কপ৩০ এর দরকষাকষিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। ইতোমধ্যেই তারা কপ৩০-এর আয়োজক ব্রাজিলের সঙ্গে একটি সমঝোতা সেরে ফেলেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, কপ৩০ আয়োজনের আগে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় লক্ষ্য অর্জন করা। একই সময়ে ব্রাজিল কপ২৯ আয়োজক আজারবাইজানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে একই উদেশ্যে কাজ অব্যাহত রাখবে।

কপ২৮ সম্মেলনে সকল পক্ষ একমত হয়েছে যে ২০২৪ সালের ১১ থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত কপ২৯ আয়োজন করবে আজারবাইজান। আর, ২০২৫ সালের ১০ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত কপ৩০ আয়োজন করবে ব্রাজিল। বছর দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। যখন দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিলে নতুন ও অধিক অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে করতে হবে।

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কোনো দেশের জন্যই বাধ্যতামূলক নয়। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াও অধিকাংশের মতামতে নয় – এটি হয় সকল দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। ফলে প্রতিটি কপেই ‘ট্রেড-অফ’ করে সমঝোতায় পৌঁছাতে হয়। কপ২৮ও এর বাইরে নয়। তবে এর বড় অর্জন লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের যাত্রা শুরু এবং ৮০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই প্রথম রাষ্ট্রসমুূহ সকল ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পক্ষে একটি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে। সম্মিলিতভাবে গৃহীত হয়েছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াল রোডম্যাপ। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ পর্যন্ত বার্ষিক ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০৫০ পর্যন্ত বার্ষিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার জোগান নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নইলে বিশ্বের কোনো দেশই – হোক সেটা উন্নত, উন্নয়নশীল বা অতিঝুঁকিপূর্ণ – আর টিকে থাকবে না। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করাই হবে বিশ্বের রক্ষাকবচ।

কপ২৮ ফ্যাক্টশিট

*    এই সম্মেলনে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ তহবিল সংগৃহীত হয়েছে। ফলে সূচনা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এক নতুন যুগের।

*     কপ২৮-এর প্রথম দিনেই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবেলায় করা এই চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রন্টলাইন কর্মীদের সহায়তা করা হবে।

*     জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে অতিরিক্ত ৯ বিলিয়ন ডলার করে বিনিয়োগ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

*    বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ২২.৬ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।

সম্মিলনে আর্থিক প্রতিশ্রুতির আদ্যোপান্ত

*    ৭৯২ মিলিয়ন ডলারের লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড।

*     গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ৩.৫ বিলিয়ন ডলার (দ্বিতীয় ধাপে ১২.৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধির সুযোগ রাখা হয়েছে)।

*     অ্যাডাপটেশন ফান্ড ১৩৪ মিলিয়ন ডলার।

*     স্বল্পোন্নত দেশ তহবিল ১২৯.৩ মিলিয়ন ডলার।

*   স্পেশাল ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড ৩১ মিলিয়ন ডলার।

*     নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৫ বিলিয়ন ডলার।

*     কুলিং ৫৭ মিলিয়ন ডলার।

*    ক্লিন কুকিং ৩০ মিলিয়ন ডলার।

*     প্রযুক্তি ৫৬৮ মিলিয়ন ডলার।

*     মিথেন ১.২ বিলিয়ন ডলার।

*     জলবায়ু অর্থায়ন: সংযুক্ত আরব আমিরাত দেবে ৩০ বিলিয়ন ডলার, স্পেশাল ড্রইং রাইটস থেকে আসবে ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং উন্নয়ন ব্যাংকগুলো দেবে ৩১.৬ বিলিয়ন ডলার।

*     খাদ্য ৩.১ বিলিয়ন ডলার।

*     প্রকৃতি ২.৬ বিলিয়ন ডলার।

*     স্বাস্থ্য ২.৯ বিলিয়ন ডলার।

*    পানি ১৫০ মিলিয়ন ডলার।

*    লিঙ্গ সমতা ২.৮ মিলিয়ন ডলার।

*     ত্রাণ, উদ্ধার এবং শান্তি ১.২ বিলিয়ন ডলার।

*    স্থানীয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ৪৬৭ মিলিয়ন ডলার।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশ

*     গ্লোবাল রিনুয়েবল অ্যান্ড এনার্জি এফিশিয়েন্সি বিষয়ক প্রতিশ্রুতিতে সম্মত হয়েছে ১৩০টি দেশ।

*     ইউএই ডিক্লারেশন অফ এগ্রিকালচার ফুড অ্যান্ড ক্লাইমেটে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৫৩টি দেশ।

*    ইউএই ডিক্লারেশন অন ক্লাইমেট হেলথে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৪১টি দেশ।

*     ইউই ডিক্লারেশন অফ ক্লাইমেট ফাইন্যান্সে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৩টি দেশ।

*    গ্লোবাল কুলিং প্লেজে স্বীকৃতি দিয়েছে ৬৬টি দেশ।

*     ডিক্লারেশন অফ ক্লাইমেট রিলিফ রিকভারি অ্যান্ড পিস-এ স্বীকৃতি দিয়েছে ৭৮টি দেশ এবং ৪০টি সংস্থা।

*     ইউএই ডিক্লারেশন অন হাইড্রোজেন অ্যান্ড ডেরিভেটিস-এ স্বীকৃতি দিয়েছে ৩৭টি দেশ।

*    ইউএই ডিক্লারেশন অন জেন্ডার রেস্পন্সিভ জাস্ট ট্রাজিশনে স্বীকৃতি দিয়েছে ৭৮টি দেশ।

*    দ্যা কোয়ালিশন অফ হাই অ্যাম্বিশান মাল্টিলেভেল পার্টনারশিপ প্লেজে স্বীকৃতি দিয়েছে ৬৭টি দেশ।

*     দা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডি কার্বোনেশন চার্টারে স্বীকৃতি দিয়েছে ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক তেল উৎপাদনকারী ৫২টি কোম্পানি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 4 =