মুশফিকুর রহমানগত ৪ এপ্রিল ২০২৩ সকাল থেকে সারাদিন ধরে ঢাকার ‘বঙ্গবাজার’ মার্কেট কমপ্লেক্সের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার ব্রিগেডকে পানি সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। আগুন নেভানোর পানির অভাব মেটাতে এক পর্যায়ে ফায়ার ব্রিগেড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহবাগ এলাকায় অনেকগুলো বড় পুকুর ছিল যা গত কয়েক দশকে বিলীন হয়েছে। বঙ্গবাজারের আগুন নেভানোর পানির সঙ্কটে এর সন্নিহিত এলাকায় অনেকগুলো হারিয়ে যাওয়া পুকুর এবং খাল সহায়ক হতে পারতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ঢাকার অবশিষ্ট পুকুর, জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প এগিয়ে নেবার অব্যাহত প্রয়াসে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছেই। ভূপৃষ্ঠের পানির সঞ্চয়ক্ষেত্র (পুকুর, জলাশয়, নদ-নদী) ভূগর্ভের পানিবাহী স্তরসমূহকে পুনর্ভরণ করতে সহায়তা করে। ভূপৃষ্ঠের জলাধার ভরাট হলে ভূগর্ভের পানি দুর্লভ হয় ।
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ এবং নিম্ন অববাহিকার দেশ। এ-দেশের উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলির মতো বিশাল নদ-নদী এবং তাদের কয়েক শত শাখা-প্রশাখা, উপ-নদী প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। বিপুল পরিমাণ মিঠা পানি এবং তার সাথে উর্বর পলিমাটি নদীবাহিত হয়ে এদেশকে উর্বর ও সমৃদ্ধ করেছে। দেশে বছরে গড়ে প্রায় ১,৫০০-৫,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষায় বিপুল পরিমাণ পানি নদ-নদী এবং তাদের অববাহিকা অঞ্চলকে প্লাবিত করে; খাল-বিল-নালা-নদী সব হয়ে পড়ে জলে ভরভর। অথচ শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজে আমাদের ভূ-পৃষ্ঠের জলাধার থেকে পানি না পেয়ে ভূগর্ভের পানি তুলে সেচ দিতে হয়। কার্যত ৮০% সেচের এবং ৯৮% গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার ও সুপেয় পানির যোগান দিতে আমাদের নির্ভর করতে হয় ভূ-গর্ভস্থ্য পানির সরবরাহের উপর। সেচ, শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয় পানি এবং সুপেয় পানীয় জলের যোগান পেতে বিরতিহীনভাবে উত্তোলন করা হয় ভূ-গর্ভের সঞ্চিত জল। বিশ^ব্যাংকের বিশেষজ্ঞগণের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেচ, গৃহস্থালি ও পানীয় জল এবং শিল্পকারখানার প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় ৩২ কিউবিক কিলোমিটার পরিমাণ পানি ভূগর্ভের উৎস থেকে আহরণ করা হয়।
বিপুল পরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ্য উৎস থেকে উত্তোলন করবার সাথে সাথে ভূগর্ভের পানির স্তর সমূহে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির রি-চার্জ বা পুনর্ভরন হওয়া বাঞ্চনীয়। তা না হলে, ভূগর্ভের পানির স্তর অবনমিত হতে থাকে। ফলে, ভূগর্ভস্থ্য পানি উত্তোলন করতে গভীর থেকে গভীরতর পানিবাহি স্তরের সন্ধান করতে হয়। পানি উত্তোলন কঠিন ও ব্যয়বহুল হতে থাকে। ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর বিশেষত্ব থাকায় কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তরে প্রয়োজনীয় পুনর্ভরণ না হলে পানিবাহি ভূ-স্তর পানিশূন্য হয়ে যেতে পারে। এর পরিবেশগত এবং আর্থসামাজিক প্রভাব ব্যাপক।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর অধীন ভূগর্ভস্থ্য পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তর বিগত ৬০ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে সারা দেশের ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তর সমূহের অবস্থা এবং তার নানামুখী পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সারা দেশজুড়ে পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তরের ভূগর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন গভীরতায় স্থাপিত কূপ ও সেগুলোর সাথে সংযুক্ত পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিরামহীনভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ অব্যাহত রেখেছে। সে সকল সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীগণ সম্প্রতি কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর অধীন ভূ-গর্ভস্থ্য পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তর এর পরিচালক (ভূতত্ত্ব) ড. আনোয়ার জাহিদ জানালেন যে, বাংলাদেশের সব এলাকায় ভূগর্ভস্থ্য পানিবাহী স্তর সমূহ সমানভাবে রি-চার্জ হচ্ছে না। ভূগর্ভস্থ্য পানিবাহী স্তর সমূহ থেকে সেচের জন্য শুকনো মৌসুমে যে দ্রুততায় পানি উত্তোলন হরা হচ্ছে, সব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ্য জলস্তর একই দ্রুততায় পুনর্ভরন হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য বড় নগর এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভ্যরে পানিবাহী স্তরের অবনমন দ্রুত ঘটছে। কৃষিতে সেচ এবং শিল্পকারখানার প্রয়োজন মেটাতে ভূগর্ভের পানির অতিরিক্ত আহরণ এরজন্য প্রধানত দায়ী।
পৃথিবীতে মিঠা পানির সঞ্চয় নগণ্য। পানির সাথে মানুষের জীবন এবং জীবিকা উভয়ই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মানুষের সংখ্যা এবং প্রয়োজন বেড়ে চলার সাথে সাথে পানির ব্যবহার বাড়ছে। আমাদের দেশেও দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের প্রসার ঘটছে। সে সাথে উন্মুক্ত মাঠ, জলাশয় বিলুপ্ত হচ্ছে। অপরদিকে পানির দূষণ তীব্র হচ্ছে। গৃহস্থালী ও শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত দূষিত পানি পরিশোধন না করে অব্যাহতভাবে বর্জ্য হিসেবে পরিত্যাগ করা হচ্ছে। পানির প্রয়োজন মেটাতে ক্রমাগত ভূগর্ভের পানি উত্তোলন চলমান রয়েছে। ফলশ্রুতিতে দ্রুত ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় ৮৬ মিটার ও ঢাকা শহরে পানিবাহি স্তর প্রায় ৬০-৭৫ মিটার নেমে গেছে। প্রতিবছর ১-২ মিটার হারে ভূগর্ভের পানিস্তর ঢাকায় অবনমিত হচ্ছে। কিন্তু পানির ব্যবহার সাশ্রয়ের বিষয়ে আবশ্যকীয় মনযোগ সামান্যই বেড়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে প্রতি কিলোগ্রাম ধান উৎপাদনে জন্য প্রায় ৩,০০০-৩,৫০০ লিটার পানি জমিতে সেচের জন্য সরবরাহ করা হয়। উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান উৎপাদনের প্রয়োজনে দেশজুড়ে গভীর, অগভীর, হাতে চালানো অসংখ্য নলকূপ সেচ মৌসুমে ভূগর্ভের পানি টেনে তুলছে। ধান গাছের জন্য প্রতি কেজিতে প্রায় ৭৫০ লিটার পানি কাজে লাগে। অবশিষ্ট সেচের পানি অপচয় হয়, প্রকৃতিতে মিলিয়ে যায়। দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে অনেক কম পরিমাণ পানি ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। একইভাবে, শিল্প কারখানার ব্যবহৃত ও দূষিত পানি পরিশোধন করে পুনচক্রায়ন করা গেলে চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা সহায়ক হয়। সে সাথে ক্রমাগত ভূগর্ভের পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকা সম্ভব হয়। তাছাড়া, পরিকল্পিত নগরায়ন করা গেলে নগরীর বর্জ্য পানি পরিশোধন করে পুনরায় তা গৃহস্থালী, শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। সেই সাথে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও তার ব্যবহার বাড়ানো গেলে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব ।
দেশে যে দ্রুততায় ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট, পানির উত্তোলনের হার ভূগর্ভের পানির স্তর পুনর্ভরণ বা রি-চার্জ-এর হারের চেয়ে দ্রুত গতিতে ঘটছে। সে কারণে ভূগর্ভের পানি স্তরকে কৃত্রিম কিন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে রি-চার্জ করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হচ্ছে। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ে কারিগরি পর্যালোচনা চলমান রয়েছে।
পানির দেশে বসবাস করি বলেই আমাদের সারা বছর ধরে অঢেল পানির যোগান পাওয়া সহজ নয়। ভূগর্ভের পানির উপর অতি নির্ভরতা এবং অতি আহরণের কারণে পানিবাহী স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পানি উত্তোলন দুঃসাধ্য এবং ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। সুতরাং এখনই সময় সচেতন হবার এবং পানির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করার।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ