১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৩, কাঁটায় কাঁটায় ৪০ বছর। মাহমুদুল ইসলাম খান যিনি চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন অঙ্গনে। যিনি সকলের কাছে রিপন খান হিসেবে অধিক পরিচিত। বিজ্ঞাপনের একটা জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে জিঙ্গেল (বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত গান)। দেশের জিঙ্গেলে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র রিপন খান। অনেকে তাকে ডাকে জিঙ্গেল কিং আবার অনেকে জিঙ্গেল সম্রাট। দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে ২০ হাজারের অধিক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। ‘পায়ের ছাপ’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২-এ শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। তার সম্পর্কে জানাচ্ছে গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।
সংগীতের সঙ্গে যোগাযোগ পরিবার থেকে
রিপন খানের বাবা মইনুল ইসলাম খান একজন সংগীতশিল্পী এবং প্রশিক্ষক ছিলেন। বাবার কাছেই রিপনের হাতেখড়ি। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন। সুর-সংগীত নিয়ে কাজ করার বীজটা বুনে দিয়েছিলেন রিপন খানের বাবা। রিপন কাজ শুরু করেন ৮০র দশকে। মূলত বিজ্ঞাপনে কাজ করার মাধ্যমেই মিউজিকের সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপন হয়। তার বয়স যখন ১৬ বছর তখন ‘সময়’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। ‘সময়’ গণসংগীত আর নাটক মঞ্চায়িত করতো। তিনি সেখানে নাটকে অভিনয় করতেন আবার গানের দলেও যুক্ত থাকতেন। জীবনে প্রথম কাজ করে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১০০ টাকা। আজ থেকে ৪০ বছর আগে। কাজটা করার অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। একদিন সিনিয়র কিছু মিউজিশিয়ান একজন ক্লায়েন্টকে একটা মিউজিক করে শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু ক্লায়েন্ট কোনোভাবেই পছন্দ করছিলেন না। তখন তিনি জিঙ্গেল শুনে মিউজিক করে তাদের শোনান এবং তা সবাই পছন্দও করে। রেকর্ড হওয়ার পর জিঙ্গেলটা শহর থেকে গ্রামের মানুষদের কাছে পৌঁছে যায়। তা ছিল দন্ত সংস্কার টুথপেস্ট কোম্পানির এক বিজ্ঞাপন। যা রীতিমতো ভাইরাল সেই সময়ে। তারপর একদিন মনোজ বন্দ্যোপাধ্যান নামের এক নির্মাতা রিপনকে একটা জিঙ্গেল করে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। তখন একটা জিঙ্গেল করলে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ছিল ২ হাজার টাকা। তিনি বললেন, ৬ হাজার টাকা দিলে কাজটা করবো। অবাক করা বিষয় সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে রিপন খান জিঙ্গেলটা করেছিলেন। জিঙ্গেলে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বেবী নাজনীন। ‘ঝুমকা প্রিন্ট শাড়ি’র এই বিজ্ঞাপন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। রিপন খানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে শোবিজ পাড়ায়। তারপরের গল্পটা সকলের জানা। একের পর এক চমৎকার কাজ উপহার দিয়েছেন। কাজ করেছেন দেশের সকল গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে। তবে তিনি মনে করেন, জিঙ্গেল হিট হওয়ার চেয়ে প্রোডাক্ট হিট হওয়া জরুরি।
করেছেন ২০ হাজার বিজ্ঞাপন
রিপন খান দেশের সংগীতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন লম্বা সময় ধরে। জিঙ্গেল করে জয় করেছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। তিনি এখন অব্দি প্রায় বিশ হাজারের মতো জিঙ্গেলে সুর-সংগীত করেছেন। কোনো কোনো জিঙ্গেলে নিজেও কণ্ঠ দিয়েছেন। শাকিলা জাফর কণ্ঠে ‘হারানো সেই দিন মনে ভাসে আজও, এখনো সজীব যেন হয়নি বিলীন’, মেরিল বেবি লোশনের ‘ও লে লে পাপ্পা সোনাজাদু মণিরে’, হেনোলাক্সের বিজ্ঞাপন ‘কি মিষ্টি মিষ্টি অপলক দৃষ্টি, অপরূপ সুন্দর লাগছে’, স্টারশিপের বিজ্ঞাপন ‘বেশি স্বাদ বেশি লাভ, বেশি কাপ চা’ কাজগুলো কালজয়ী হয়ে থাকবে। এছাড়া বিভিন্ন শাড়ির বিজ্ঞাপন, যেমন জনি প্রিন্ট শাড়ি, অ্যারোমেটিক, কেয়াসহ অনেক পণ্যের জিঙ্গেল করেছেন তিনি।
রিপন খান যখন বিজ্ঞাপনে কাজ শুরু করেন তখনকার কাজের ধরন আর বর্তমানের কাজের ধরনে রয়েছে আকাশপাতাল তফাত। তিনি মনে করেন কাজে ধ্যানজ্ঞান দিলে সময় কোনো বিষয় না। বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রায় সব কোম্পানির সাথে কাজ করছেন তিনি। নিজের রেকর্ডিং স্টুডিওতে কাজ করে যাচ্ছেন এখনও নিয়মিত।
জিঙ্গেল কিং রিপন খান
বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল করতে করতে জিঙ্গেল কিং উপাধি পেয়ে গিয়েছিলেন রিপন খান। এই উপাধিটা কবে, কখন, কীভাবে হলো সে সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট কিছু জানেন না। মূলত মিডিয়া অঙ্গনে মানুষের মুখে মুখে কথাটা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পত্রিকাগুলোও ‘জিঙ্গেল কিং’ হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করেছে। তিনি জানান, এটা আসলে আমাকে কবে কিংবা কে দিয়েছে তা বলতে পারছি না। তবে জিঙ্গেল কিং উপাধিটা বিশাল এক স্বীকৃতি। এটা ভাবতেই অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে।
বাবার পথেই হেঁটেছে দুই ছেলে
বাংলাদেশের সংগীতের খানিকটা খোঁজ খবর রাখলে আপনি নিশ্চয়ই হৃদয় খানের নামটার সঙ্গে পরিচিত। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক রিপন খানের বড় ছেলে হৃদয় খান। ছোট ছেলে প্রত্যয় খানও বাবা ও বড় ভাইয়ের মতো এসেছেন সংগীত ভুবনে। রিপন খানের দুই ছেলে বাবার পথেই হেঁটেছেন। সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছেন সংগীতকে। হৃদয় খান এবং প্রত্যয় খান দুজনই স্ব স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের প্রিয় মুখ হৃদয় খান ও প্রত্যয় খান। গায়কির পাশাপাশি তারা দুই ভাই সুরকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবেও সফলভাবে কাজ করছেন। বড় ছেলে হৃদয় খান নিজেকে প্রমাণ করেছেন বহুবার। ২০০৮ সালে প্রথম অ্যালবাম ‘হৃদয় মিক্স’ প্রকাশের পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তরুণ শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছেন দীর্ঘ এক যুগ ধরে। ছোট ছেলে প্রত্যয় খান গানের পাশাপাশি এখন ওভিসি, টিভিসি, ডকুমেন্টরি, আবহসংগীতের কাজও করছেন নিয়মিত।
প্রথম বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
রিপন খান ‘পায়ের ছাপ’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২-এ শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেছেন। ‘পায়ের ছাপ’ সিনেমাটি ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। এটি নির্মাণ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা সাইফুল ইসলাম মান্নু। রিপন খানের কাছে অনূভুতি জানতে চাইলে জানান, আসলে কিছু প্রাপ্তির অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছি এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে আমার কখনই কোনো ভাবনা কাজ করেনি। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে আমি মানুষের অনেক ভালোবাসা ও সম্মান পেয়ে আসছি। তবে একটা সময়ে এসে মনে হলো ভালোবেসে যে কাজ করতে গিয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করলাম, আমি কি জাতীয় স্বীকৃতি পাব না? আমি জিঙ্গেলের সঙ্গে যুক্ত আছি দীর্ঘ সময় ধরে। যেহেতু জিঙ্গেলে কোনো অ্যাওয়ার্ড নেই তাই এই ভাবনা আমার মনের মধ্যে উঁকি দিত, সেখান থেকেই আক্ষেপ বাড়ত। পাঁচ বছর ধরেই সেই আক্ষেপ আমাকে ভাবাচ্ছিল। এরপর চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করলাম। ভালো কাজ করলে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাস কাজ করত। আজ আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
‘পায়ের ছাপ’ চলচ্চিত্রের আবহ সংগীত করার মাধ্যমে এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গান করেছেন শওকত আলী ইমন। তিনি সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। যখন এই ছবির সম্পূর্ণ মিউজিক করলাম, তখন আমার সাহসটা বেড়ে গেল। এত সুন্দর স্টোরি, এখানে মাটির মিউজিক করেছি, ওয়েস্টার্ন আছে। ইডিএম করেছি, আবার ফোক, মেলোডিও আছে। সব ধরনের কাজ করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সিকোয়েন্স ফুটিয়ে তুলেছি মিউজিক দিয়ে।
সিনেমার কাজ
দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করলেও সিনেমার কাজে তেমন একটা পাওয়া যায়নি রিপন খানকে। সিনেমার গান করার জন্য প্রস্তাব পাননি এমনটা কিন্তু নয়। তিনি জানালেন, ২০০০ সালের শুরুর দিকে কপি গান, কপি স্টোরি, হিন্দি গানের স্টোরির বাজে একটা প্রচলন ছিল। এজন্য তিনি কাজ করতে চাইতেন না। ভালো ছবির সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। যারা কাজ করতেন তারা সবাই ভালো কাজ করছেন বলে তার মনে হয়েছে। তার প্রয়োজন নেই এমন অনূভুতি কাজ করেছে। তার মনে হয়েছে জিঙ্গেল করার মতো খুব বেশি মানুষ ছিল না। কাজ করতে করতে একপর্যায়ে জিঙ্গেল নির্মাতাদের কাছে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছিলেন। একপর্যায়ে বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রির মানুষরা তাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইত না। যার ফলে বিজ্ঞাপন নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তিনি জানান, বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রি আমাকে তাদের প্রয়োজন মনে করে। যার কারণে আমি জিঙ্গেল নিয়েই ব্যস্ত থাকি। এখন অব্দি মাত্র ছয়টি সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পায়ের ছাপ’ ও ‘অনাবৃত’, নজরুল ইসলামের ‘চিরঞ্জীব মুজিব’, শহীদ রায়হানের ‘মনোলোক’, ছটকু আহমেদের ‘আহারে জীবন’, মাসুদ জাকারিয়া সাবিনের ‘মুক্তির ছোট গল্প’। এর মধ্যে কিছু সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু সিনেমার কাজ করছেন বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি। ভবিষ্যতে ভালো সিনেমার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন তিনি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে