টালিগঞ্জে জয়ার ১ দশক

টিভি নাটক থেকে বড় পর্দায় জয়া আহসান নিজেকে প্রমাণ করেছেন বহুবার। যেকোনো চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম তিনি। দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পাশাপাশি কলকাতায় তার ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। টলিউডে দশ বছর পার করেছেন বাংলাদেশের গুণী এই অভিনেত্রী। কলকাতার সিনেমায় অভিনয় করে টানা তিন বছর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। সর্বশেষ মুক্তি পেয়েছে কৌশিক গাঙ্গুলির ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমা। ‘মেঘনা মুস্তাফি’ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন জয়া আহসান। ঢাকা টু কোলকাতা জার্নির দশ বছর সম্পর্কে রঙ বেরঙয়ের প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানা যাক।

জয়া আহসানের বড় পর্দায় অভিষেক হয় ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ সিনেমায় ‘শায়লা’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতে জানান দিয়েছিলেন তিনি অভিনয়টা জানেন। তারপর লম্বা সময় বড় পর্দায় দেখা যায়নি তাকে। ২০১০ সালে নুরুল আলম আতিকের ‘ডুবসাঁতার’ সিনেমায় ‘রেনুকা রহমান’ চরিত্রে অভিনয় করেন। জয়া আহসান বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ সিনেমায় অভিনয় করে। ২০১১ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটিতে ‘বিলকিস বানু’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। পরের বছর রেদোয়ান রনির ‘চোরাবালি’ সিনেমায় ‘নোবানি আফরোজ’ চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন।

জয়া আহসান বাংলাদেশের সিনেমায় খুব বেছে কাজ করেছেন তা বলতেই হয়। সিনেমা সিলেকশন করেছেন খুবই সূক্ষ্মভাবে। নিজের ক্যারিয়ার গ্রাফে মানহীন সিনেমার সংখ্যা নেই বললেই চলে। একজন অভিনেত্রীর জন্য এটা আসলেই বড় একটা অর্জন। অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’ সিনেমায় ‘সানিয়া’ চরিত্রে ও অনম বিশ্বাসের ‘দেবী’ সিনেমায় ‘রানু’ চরিত্রে অসাধারণ পারফর্ম করার জন্য দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। জয়া আহসান ২০০৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনীত হন।

২০১৩ সালে অরিন্দম শীলের ‘আবর্ত’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে কলকাতার সিনেমায় অভিষেক হয় জয়া আহসানের। ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ নবীন অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন জয়া আহসান। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় তাকে। একের পর এক কলকাতার গুণী নির্মাতা ও শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন আমাদের জয়া আহসান। ২০১৫ সালে কলকাতায় জয়া আহসানের দুটি সিনেমা মুক্তি পায়। ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর ‘একটি বাঙ্গালী ভুতের গোপ্পো’ ও সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘রাজকাহিনী’ সিনেমায় অভিনয় করেন জয়া। ২০১৬ সালেও জয়ার দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় কলকাতায়। অরিন্দম শীলের ‘ঈগলের চোখ’ ও ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর ‘ভালোবাসার শহর’ সিনেমায় অভিনয় করেন। ‘ঈগলের চোখ’ সিনেমায় ‘শিবাঙ্গী’ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিলে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে।

২০১৭ সালে কৌশিক গাঙ্গুলির ‘বিসর্জন’ সিনেমায় অভিনয় করার মাধ্যমে প্রথম বারের মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। যার মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভারতের ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান অভিনেত্রী জয়া আহসান। ‘বিসর্জন’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা অর্জন করেন এই অভিনেত্রী। জয়া আহসানকে ‘পদ্মা’ চরিত্রে দেখে দর্শক বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। দুর্দান্তভাবে নিজেকে হাজির করেছিলেন সিনেমায়। নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফর্ম করেছিলেন পর্দায়। সেবছর মনোজ মিশিগানের ‘আমি জয় চ্যাটার্জী’ সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে দেখা যায় জয়া আহসানকে।

২০১৮ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক যে ছিল রাজা’ ও বিরসা দাশগুপ্তের ‘ক্রিসক্রস’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন জয়া। ২০১৯ সালে জয়া অভিনীত ৪টি সিনেমা মুক্তি পায় টলিউডে। কৌশিক গাঙ্গুলির ‘বিজয়া’, অর্ণব পালের ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের যৌথ পরিচালনায় ‘কণ্ঠ’ ও অতুন ঘোষের ‘রবিবার’ সিনেমায় দেখা যায় তাকে। ‘রবিবার’ সিনেমায় জয়া আহসানের বিপরীতে ছিলেন বুম্বা দা খ্যাত অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ২০২১ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে ‘রবিবার’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০২১ সালে অতুন ঘোষের ‘বিনিসুতোয়’ সিনেমায় ‘শ্রাবণী বড়ুয়া’ চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান। ‘বিনিসুতোয়’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য জনপ্রিয় শাখায় ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন জয়া আহসান।

সর্বশেষ জয়া আহসানকে দেখা যায় টলিউডের নন্দিত নির্মাতা-অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলির ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমায়। ২ জুন ভারতে মুক্তি পায় ১৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে সিনেমাটি। মূলত এক পুরুষের জীবনে দুই নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। একজন তার প্রাক্তন ও একজন বর্তমান। এই দুইজন নারীই সত্যিই সেই পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি না, তা নিয়ে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমাটির গল্প আবর্তিত হয়েছে। বর্তমান স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। ‘মেঘনা মুস্তাফি’ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন জয়া আহসান। এই নির্মাতার (কৌশিক গাঙ্গুলি) ‘বিসর্জন’ ও ‘বিজয়া’ ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করার সুবাদে জয়া আহসান পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। বলা যায় না নিজের নামের পাশের নতুন ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড যুক্ত হয়ে যেতে পারে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। এবছর জয়া আহসানের বেশ কিছু সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ভূতপরী, ওসিডি, কালান্তর, পুতুল নাছের ইতিকথা।

‘সিটি অব জয়’ খ্যাত শহরে গিয়ে আমাদের দেশের অভিনেত্রী শুধুমাত্র নিজের অভিনয় শৈলী দিয়েই জয় করছেন অজস্র মানুষের মন। যার জলজ্যান্ত প্রমাণ একমাত্র বাংলাদেশি অভিনেত্রী হিসেবে তিন তিনটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। টালিগঞ্জ পাড়ায় সফলতার সঙ্গে ২০১৩ থেকে ২০২৩ এক দশক কাটিয়ে ফেললেন জয়া আহসান। এক সাক্ষাৎকারে জয়া আহসান ভারতে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছেন, “আমি দ্বিতীয় একটা দেশ পেয়েছি। ছোটবেলা থেকে এত গল্প শুনেছি, ভারতকে কখনও আলাদা দেশ ভাবতাম না। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি বলতেন ভারত আমাদেরই দেশ। বাবা সবসময় দু’দেশের কথা বলতে গিয়ে ‘আমরা’ করেই বলতেন। কলকাতাকে আলাদা করে দেখেননি। সেটাকে নতুন করে পাওয়া আমার কাজের মধ্য দিয়ে। বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। এখান থেকে অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছি, এখানকার মানুষ আমাকে ভালোবাসছে, এটা দেখতে পেলে বাবা ভীষণ খুশি হতেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাবাকে খুব মিস করি।”

অভিনেত্রী জয়া আহসান এক দশক ধরে কলকাতার সিনেমায় অভিনয় করে ইতিমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন তা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। ঢালিউড আর টলিউড পেরিয়ে জয়া আহসানকে এবার দেখা যাবে বলিউডে। প্রথম বারের মতো অভিনয় করেছেন ‘কাদাক সিং’ নামের হিন্দি সিনেমায়। অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী পরিচালিত সিনেমাটিতে জয়া আহসানের সহশিল্পী পঙ্কজ ত্রিপাঠী ও সানজানা সঙ্গী।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 4 =