ময়ূরাক্ষী সেন
সাব্বির ও মিলা। প্রায় তিন বছর হতে চললো তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দ্বিতীয় বছর থেকেই তারা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনোভাবেই মিলা সন্তানধারণে সফল হতে পারছে না। পরবর্তীতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রাথমিক অবস্থায় তাদের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর চিকিৎসক তাদের টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ এর কথা জানান। চিকিৎসক তাদের জানান এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে তারা সন্তান ধারণ করতে পারবে। মিলা ও সাব্বির যখন টেস্ট টিউব বেবি নেওয়ার সিদ্ধান্তে আসেন তখন পরিবার ও সমাজ থেকে এই পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য পেতে থাকেন। পরবর্তীতে তারা বিভ্রান্ত হয়ে যান এই চিকিৎসা পদ্ধতি আসলেই তাদের নেওয়া উচিত কি না। তাদের মতো আমাদের দেশের অনেক দম্পতিরাই টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন না। ফলস্বরূপ তাদের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের মধ্যে পড়তে হয়।
পুরো বিশ্বজুড়ে বন্ধ্যাত্বের হার বেড়েই চলছে। আমাদের দেশে বন্ধ্যাত্বের হার ১২% এরও বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী নারী ও পুরুষ যে কেউ হতে পারে তবুও আমাদের দেশে বন্ধ্যাত্বের জন্য নারীদের দায়ী করা হয়। বাচ্চা না হওয়ার জন্য সংসার ভেঙে যাওয়া কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে করার মতো ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন নয়। বিভিন্ন হাসপাতালে সন্তানের মা হওয়ার জন্য ওয়েটিং রুমে নারীদের বিষণ্ন ও উদাস মুখ দেখতে পাওয়া যায়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া গর্ভধারণে সফল না হলে চিকিৎসক তাকে বন্ধ্যাত্ব বলে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০টি দম্পতির মধ্যে ৮টি দম্পত্তি সন্তান নিতে ব্যর্থ হন। সুতরাং বলা যাচ্ছে বন্ধ্যাত্বের সংখ্যা পুরো বিশ্বজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করছে।
চিকিৎসকরা জানান সন্তানধারণে অক্ষম নারী ও পুরুষের সংখ্যা একই রকম। বন্ধ্যাত্বের ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে নারী, ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ, বাকি ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের কোনো সমস্যা থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে হরমোনজনিত সমস্যা, থাইরয়েডে সমস্যা, পিসিওএস, অতিরিক্ত ওজন কিংবা অতিরিক্ত কম ওজন, দেরিতে সন্তানধারণের চেষ্টা, মানসিক চাপ, ক্যান্সার, জীবনযাপন, যৌনবাহিত রোগ, ডিম্বাশয় ছোট থাকা বা যেকোনো ধরনের জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি সমস্যার কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে বীর্যে সমস্যা। এজোস্পার্মিয়া বা শুক্রাণুর অনুপস্থিতি; যা দুই কারণে হতে পারে। যেমন উৎপাদনই হচ্ছে না বা শুক্রাণু আসার পথে কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ওলিগোস্পার্মিয়া; যাতে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া, অচল শুক্রাণু ও ত্রুটিযুক্ত শুক্রাণু অধিক থাকা। পুরুষের প্রধান হরমোন সঠিক মাত্রায় না থাকা, অতিরিক্ত ধূমপান, যৌনবাহিত রোগ, যক্ষা, ছোটবেলায় মাম্পস ইত্যাদি কারণ বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ফলে ৮০% দম্পতি এখন গর্ভধারণে সফল হয়। তাই বিয়ের পর সন্তান নেওয়ার চেষ্টায় নিজেরা সফল না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক কিছু ঔষধ ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। তবে যেকোনো চিকিৎসা শুরু করার আগে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই নানা ধরনের পরীক্ষা করানো হয়। এর মাধ্যমে বের হয়ে আসে ঠিক কি কারণে এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বন্ধ্যাত্ব কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য চিকিৎসকেরা জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করার কথা বলে থাকেন। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অনেক সময় বন্ধ্যাত্বর জন্য দায়ী হয়ে থাকে। তাই প্রথমে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন ঘরে তৈরি খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণ না করা, শারীরিক পরিশ্রম করা, ওজন কমিয়ে স্বাভাবিক রাখা, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো, মানসিক চাপ বা স্ট্রেস মুক্ত থাকা ইত্যাদি। অনেক নারীদের অতিরিক্ত ওজন থাকার কারণে গর্ভধারণের সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন সঠিক ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে নিয়ে আসতে। এছাড়া ধুমপান ও যেকোনো ধরনের নেশা পরিহার করা প্রয়োজন।
গর্ভধারণ করতে ব্যর্থ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসক প্রথমে ইতিহাস জেনে নেন এবং কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে থাকেন। প্রাথমিক অবস্থায় বন্ধ্যাত্বের জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে সেসব চিকিৎসায় ব্যর্থ হলেই চিকিৎসকেরা টেস্ট টিউব বেবির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে স্কয়ার হাসপাতালে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয় ২০০১ সালে। পৃথিবীর প্রথম টেস্ট টিউব বেবির নাম লুইস ব্রাউন। সে একজন মেয়ে। ১৯৭৮ সালে ব্রিটেনে লুইসের জন্ম ছিল বিংশ শতাব্দীর মেডিকেল ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এক মাইলফলক।
বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় টেস্ট টিউব পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয় ফলিকুলার পরিপক্বতার এবং ডিম্বাশয়ে ডিম্বস্থলন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। গর্ভধারণের জন্য মেডিকেল টেস্ট করার জন্য স্ত্রীকে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। রজঃস্রাবের ৩ দিন পর থেকেই শুরু হয় টেস্ট টিউব চিকিৎসা। এ সময় জরায়ুর আবরণকে ঘন রাখার প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে বিশেষ হরমোন গ্রহণ করতে হয়। টেস্ট টিউব প্রক্রিয়াকে সফল করতে উন্নত বিশ্বের অনেক ক্লিনিকে এখন স্বাভাবিক চিকিৎসার সঙ্গে হিপনোথেরাপি প্রয়োগ করা হচ্ছে। অন্যসব ঠিক থাকলে এ চিকিৎসা জাইগোট গ্রহীতার গর্ভধারণের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ডিম্বাশয়ে একাধিক রজঃস্রাবের গ্রন্থি তৈরি হলেই ডিম্বাণু পৃথক করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের করতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ আলট্রাসাউন্ড সূঁচ। ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে রজঃস্রাবি গ্রন্থি থেকেই ল্যাবরেটরিতে ডিম্বাণু পৃথক করা হয়। এই পৃথকীকরণে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। তারপর সেটিকে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ল্যাবে সংরক্ষণ করা হয়।
একই সময়ে স্বামীর অসংখ্য শুক্রাণু সংগ্রহ করে তা থেকে ল্যাবে বিশেষ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয় সবচেয়ে ভালো জাতের একঝাঁক শুক্রাণু। তারপর অসংখ্য সজীব ও অতি ক্রিয়াশীল শুক্রাণুকে নিষিক্তকরণের লক্ষ্যে ছেড়ে দেওয়া হয় ডিম্বাণুর পেট্রিডিশে। সংগৃহীত শুক্রাণুগুলোর সঙ্গে সেই ডিম্বাণুকে একসঙ্গে রাখা হয়। এ মিশ্রণে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর অনুপাত থাকে ৭৫০০০:১। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর এই পেট্রিডিশটিকে সংরক্ষণ করা হয় মাতৃগর্ভের অনুরূপ পরিবেশের একটি ইনকিউবিটরে। ইনকিউবিটরের মধ্যে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পরই বোঝা যায় নিষিক্তকরণের পর ভ্রুণ সৃষ্টির সফলতা সম্পর্কে। এই চিকিৎসার সফলতার সম্ভাবনা স্ত্রীর বয়স, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গুণগত মান, প্রজননে অক্ষমতার মেয়াদ, জরায়ুর স্বাস্থ্য ইত্যাদির ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল।
প্রতিবছর ২৫ জুলাই বিশ্বে আইভিএফ দিবস পালন করা হয়। তবে আইভিএফ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা এখনো অনেক কম। এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের কুসংস্কার। অনেকে মনে করেন আইভিএফ পদ্ধতিতে শুধু যমজ শিশু হয় কিংবা এই মাধ্যমে সন্তান হলে শিশুর নানা ধরনের জন্মগত ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু এইসব ভুল ধারণা থেকে মানুষকে বের করার জন্য টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। চিকিৎসকদের টেস্ট টিউব বেবি নেওয়ার জটিলতা ও সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে নিতে হবে। টেস্ট টিউব বেবি একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি কৃত্রিম উপায়ে সন্তান নেওয়া নয়, এ সম্পর্কে সকলকে ধারনা দিতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা