ডাক বিভাগ: অতীত ও বর্তমান

হাসান নীল

দূরত্ব কখনও গুরুত্ব কমাতে পারে না। প্রিয়জন যতই দূরে থাক মানুষ বিভিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে এই রীতি। একটা সময় পায়রা বা পোষা অন্যকোনো পাখির মাধ্যমে চিরকুট পাঠাত। পরে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পাঠানোর নানা মাধ্যম বের হয়। দূত মারফত, সমুূদ্র পথে, ঘোড়া টানা গাড়িতে বহন করা হতো চিঠি। এছাড়া রানারও চিঠি বহন করত। পরে এই দায়িত্ব বর্তায় ডাক বিভাগের ওপর। নব্বই দশকেও ডাকবিভাগ ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আজকাল মোবাইলফোনের প্রসারে সহজেই হাজার মাইল দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। ফলে চিঠি প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ডাক বিভাগের ইতিহাস কয়েক শ বছর পুরোনো। ১৫১৬ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন অষ্টম হেনরি। পশ্চিমা দেশগুলোতে তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ডাকেট। হেনরি এর নাম দিয়েছিলেন রয়েল মেইল সার্ভিস। এর ১৩৪ বছর পর প্রথমবারের মতো চালু হয় সাধারণ ডাক বিভাগ অর্থাৎ জেনারেল পোস্ট অফিস। দ্বিতীয় চার্লসের শাসনামল ছিল তখন। তিনিই এই পরিষেবা চালু করেছিলেন। এই সেবা চলে ১৭৫ বছর পর্যন্ত। পরে ১৮৩৫ সালে রোল্যান্ড হিল প্রকাশ করেন পোস্ট অফিস রিফর্ম। আধুনিক ডাক বিভাগের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা ছিল তাতে। ডাক বিভাগে কিছু পরিবর্তন আনতে প্রস্তাবটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেছিলেন রোল্যান্ড হিল। পরিবর্তনগুলো যে দরকার তা তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরমধ্যে একটি ছিল দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রেরককে অর্থ গুনতে হবে। চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয় ১৮৪০ সালে। ইউনিফর্ম পেনি পোস্ট চালু করা হয় সে বছর। এর মাধ্যমে নিরাপদে ও কম সময়ে প্রাপকের কাছে চিঠি পৌঁছে যেত। ডাক টিকিট পাঠানোর প্রচলনটাও শুরু হয় ইংল্যান্ড থেকে। প্রথম ডাক টিকিট ছিল পেনি ব্ল্যাক।

একসময় স্থল আর জলপথই ছিল একমাত্র অবলম্বন। সেসময় দূর দূরান্তে যাতায়াতে মানুষজনের অন্যতম ভরসা ছিল জলপথ। তাই চিঠিপত্র পাঠাতে বেছে নেওয়া হয়েছিল জলপথ। বিশ্বে প্রথম জলপথে ডাক চালু হয়েছিল ১৬৩৩ সালে। এর নাম ছিল সমুদ্র ডাক। স্থলপথে ডাক চালু হয় এর প্রায় দেড় শ বছর পর। ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে দূরান্তে চিঠিপত্র বহন করা হতো। নাম ছিল ঘোড়ার গাড়ির ডাক। তবে সেসময় কিন্তু মুদ্রিত খামের প্রচলন ছিল না। এটি শুরু হয় ১৮৩০ সালে। ডাক বিভাগের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়াও চালু হয়েছিল ১৮ শতকে। ১৮৩৮ সালে প্রথম পোস্টাল মানি অর্ডার চালু করা হয়। এর বছর দুয়েক পরই প্রথম স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। পরের বছর চালু হয় রেজিস্ট্রি ডাক সার্ভিস। আর ১৯৪৮ সালে উন্মুক্ত করা হয় বুক পোস্ট সার্ভিস। ওই দশকেই পোস্টালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

জানা যায়, ইউরোপের দেশগুলোর মতো অনেক আগে থেকেই ডাক বিভাগের প্রচলন ছিল মিশর পারস্য সম্রাজ্য ও ভারতবর্ষে। চিনেও প্রচলন ছিল। চিনে ডাকব্যবস্থা প্রসারে অবদান ছিল হ্যান রাজবংশের রাজা লি’র। তার শাসনামলে দেশে ১৬৩৯টি পোস্ট অফিস ও কুড়ি হাজারেরও বেশি ডাকপিয়ন ছিল। ভারতবর্ষেও ডাকব্যবস্থার উৎপত্তি অনেক আগে থেকে। লোকসাহিত্যেও উল্লেখ আছে দূত বা পিয়নের কথা। মহাকবি কালীদাস তার কাব্যে মেঘ ও বাতাসকেও দূত হিসেবে দেখেছেন। এছাড়া রামায়ণে হনুমান, আনার-কলিতে হরিণ প্রভৃতি প্রাণি ও পাখিকে দূত হিসেবে ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তবে সেসময় দূতদের বেশ সম্মান করা হতো। ইতিহাস বলে শত্রুতা যতই বেশি হোক, শত্রুর বার্তাবাহককে পর্যাপ্ত সম্মান করা হতো। তার ওপর কোনোরকম অত্যাচার নির্যাতন কিংবা কারাবাসের আদেশ দেওয়া হতো না। ভারতে ডাকব্যবস্থার উন্নয়ন বেশি হয়েছিল দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনকালে। তিনি অনুসরণ করেছিলেন আরবদের ঘোড়ার গাড়ির ডাক। একই উপায়ে তিনি ডাকসেবা দিল্লি থেকে বাংলা পর্যন্ত প্রসারিত করেন।

তিনি সেসময় তার ডাক বিভাগকে কয়েকটি নামে পৃথক করেছিলেন। দূত মারফত পাঠানো ডাকব্যবস্থার নাম দিয়েছিলেন কাসিদ। রানারের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিকে ডাকা হতো ধাওয়া। আর ঘোড়ার গাড়ির ডাককে বলা হতো উলাগ। পরে ডাক বিভাগের আরও সংস্কার হয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে। তিনি ডাক বিভাগের নাম দেন মাহকামা ই বারিদ। ডাক বিভাগে দুজন করে ডাক কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। প্রজাদের সুবিধার কথা ভেবে প্রতিটি শহরে একজন করে সংবাদ লেখকও নিয়োগ দেন তিনি। তাদের বলা হতো মুন্সি। পদটিকে বেশ মান্য করা হতো তখনকার দিনে। উপমহাদেশের ডাকব্যবস্থা সম্পর্কে ইবনে বতুতার লেখা থেকেও পাওয়া যায় আরও কিছু তথ্য। তার কথা অনুযায়ী ডাক বিভাগের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয় ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ সালে। এটি ছিল সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের শাসনামল। ইবনে বতুতার দেওয়া তথ্যমতে সে সময় সিন্ধু থেকে দিল্লীতে ডাক পরিবহনে বেশি সময় লাগত না। এছাড়া ওই সময় ডাক কর্মকর্তাদের বাড়তি দায়িত্ব ছিল। সেটি হলো তারা কিছুটা পুলিশের ভূমিকাও রাখত।

শের শাহর আমলে উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়েছিল ডাক বিভাগে। তার রাজত্বে নির্মাণ করা হয়েছিল ১৭০০টি ডাকঘর। এরজন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ৩৪০০ জন বার্তাবাহক তথা পিয়ন। তারা ঘোড়ায় চড়ে প্রেরকের বার্তা প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। এছাড়াও আরও কয়েকজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ডাক বিভাগের জন্য। মুঘলদের শাসনামলেও দারোগা ই চৌকি ডাক ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। সেসময় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করত প্রাদেশিক সরকার। বাংলার রাজধানী ঢাকার সাথে দিল্লির ডাক যোগাযোগ আরম্ভ করেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। এসময় ঢাকা-দিল্লি ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য তিনি ডাকচৌকির দারোগা নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। ডাক প্রেরণে কবুতরও কাজে লাগানো হয়েছিল। বাংলা থেকে উড়িষ্যা এবং রাজধানী থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত ডাক প্রেরণে কাজে লাগানো হতো কবুতর। পলাশী যুদ্ধে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে ডাক বিভাগও বেহাত হয়ে যায় ভারতের শাসকদের কাছ থেকে।

কর্তৃত্ব শুরু করে ইংরেজরা। পলাশি যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনে বাঙালির ভাগ্য দুর্দশাগ্রস্ত হলেও ডাক বিভাগের প্রতি অবিচার করেনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তবে ইংরেজরা ডাক বিভাগের তদারকি ও সংস্কারে হাত দিয়েছিল নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করে। ১৭৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভের সময় ডাক বিভাগ পরিচিতি লাভ করে ক্লাইভ ডাক হিসেবে। তিনি ডাক বিভাগকে ঢেলে সাজান। কলকাতা ডাকে পোস্টমাস্টার নিয়োগ দেন। সেইসঙ্গে পাঁচটি ডাক যোগাযোগ কেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগ ঘটান কলকাতা ডাকের। তবে ঢাকা ও পাটনার যোগাযোগটাই বেশি গুরুত্ব পেত তখন। পরে ওয়ারেন হোস্টিংসের সময় কলকাতায় প্রথম পোস্ট অফিস তৈরি করা হয়। এসময় পালকির মধ্যমে চিঠিপত্র পাঠানো শুরু হয়। আঠারে শতকের মাঝামাঝিতে এসে ভারতে চালু হয় মানি অর্ডার ব্যবস্থা। একই বছর চালু হয় রেল মেইল। এর মাধ্যমে তখন স্থানীয় ডাক বাছাই করা শুরু হয়।

এক সময় ডাক বিভাগের দায়িত্ব এসে বর্তায় জমিদারদের ওপর। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও নিজেদের প্রয়োজনে ডাকব্যবস্থা চালু করে। তাদের ডাককে বলা হতো মহাজনী ডাক। ১৭৯৮-৯৯ সালে আরও ছড়িয়ে পড়ে ডাক বিভাগ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, নাটোর, কুমারখালি, রঘুনাথপুর, সিলেট, রামুতে গড়ে উঠে কলকাতা জিপিওর শাখা অফিস। ১৮৫৪ সালে সর্বভারতীয় ডাক টিকিট চালু করা হয়। একইসঙ্গে অল্প সময়ে ডাক পৌঁছাতে চালু করা হয় রেলওয়ে মেইল সার্ভিস। পাশাপাশি চালু করা হয় লালচে কমলা ও নীল রঙের রঙিন ডাক টিকিট। আজ যে আমরা মোড়ে মোড়ে চিঠি ফেলার বাক্স তথা ডাকবাক্স দেখি এটি চালু হয় ১৮৫৬ সালের দিকে।

বাংলাদেশে ডাক বিভাগ পথচলা শুরু করে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। একইদিনে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ডাক যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক। পরের বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বিভাগটির মহাদপ্তর স্থাপন করা হয়। ওই মাসেরই ২১ তারিখ প্রকাশ করা হয় প্রথম স্মারক ডাকটিকিট। প্রথম পোস্টকোড প্রকাশ করা হয় ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল। তবে তখনও খাম প্রকাশ পায়নি। এটি প্রকাশ পায় সে বছরের ১৯ জুলাই। সত্তর দশকের শেষের দিকে চালু করা হয় রাজশাহী সার্কেল। বাংলাদেশ বিশ্ব ডাক সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মানি অর্ডার সেবা চালু করে। পরের বছরের ৫ জুলাই চালু করে বৈদেশিক পার্সেল সার্ভিস। নব্বই দশক পর্যন্ত ডাক বিভাগের দারুণ কদর ছিল। কিন্তু মোবাইল ফোনের প্রসারে আজকাল ডাক বিভাগ হারিয়েছে তার আবেদন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two + eleven =