ডাক্তারি সরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধে অর্থী

ঋষিকা

দুদিনে ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন দুইজন চিকিৎসক। চিকিৎসক চিকিৎসা দেবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে ফলাও করে তখনি সেই ঘটনা বলতে হয় যখন পেছনে কোনো ঘটনা থাকে। আর এই চিকিৎসার ঘটনা বলতে গেলে যেতে হবে কিছুটা পেছনে। জুলাই মাসের শেষের দিকে। যখন বাংলাদেশ গড়ছিল নতুন এক ইতিহাস। ঝরছিল রক্ত। রাজপথ আর বাড়ির আশেপাশে তখনও বাতাস ভারী হয়ে ছিল বারুদের গন্ধে। শিক্ষার্থীদের পাশে তখন জড়ো হতে শুরু করেছে অভিভাবক, শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ। তেমনই একটা সময় নিজের ডাক্তারী বিদ্যা নিয়ে সামনে এসেছিলেন দুইজন ডাক্তার। কয়েকও ঘণ্টার মধ্যেই নিজেদের বাড়ির গ্যারেজকে বানিয়ে তুলেছিলেন ডাক্তাখানা। চিকিৎসা দিচ্ছিলেন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বিভোর একদল তরুণ তাজা প্রাণদের। জুলাইয়ের ভয়াবহ সময়ে নিজের এলাকার আহত মানুষদের প্রাথমিক চিকিৎসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তরুণ দুই ডাক্তার। তাদের মধ্যে একজন ডা. অর্থী জুখরীফ। পেশাগত দিকও থেকে তিনি কর্মরত আছেন একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে।

যুদ্ধ যুদ্ধ সময়

১৮ জুলাই, দেশের পরিস্থিতি তখন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সব যোগাযোগ বন্ধ অরাজকতার কারণে। সবাই বাড়িতে বসে, খুব জরুরি না হলে কেউ বের হচ্ছেন না বাসা থেকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী নেমে পড়েছেন রাস্তায়। তাদের দাবি রক্তের হিসাব নিতেই হবে। রাজধানীর ধানমন্ডির বাড়িতে বসে সেদিন মুহূর্মুহূ গুলির আওয়াজ শুনছিলেন অর্থী। দেশের পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছিল। ধানমন্ডির আশপাশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আসে। খণ্ড খণ্ড মিছিল, সেøাগান। চারিদিকে চিৎকার, হুড়োহুড়ি। উৎসুক এলাকার সব মানুষ। কেউ কেউ এসে দাঁড়াচ্ছেন নিজেদের বেলকনিতে, কি হচ্ছে তা বোঝার জন্য। আতঙ্ক নিয়ে সেদিন অর্থীও দাঁড়িয়েছিলেন নিজের বাড়ির বেলকনিতে। দেখতে পেলেন ভয়াবহ চিত্র। স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছুটছেন গলিতে গলিতে। তারা কেউ কেউ আহত। কেউ মার খেয়েছেন, আবার কারো গুলি লেগেছে। কারো হাতে আঘাত, কারো মাথায়, কারো চোখে। কারো পায়ে লেগেছে গুলি, কাতরাচ্ছেন রাস্তায় পরেই। বেলা গড়াতেই বাড়ছিল চিৎকার আর আর্তনাদের মাত্রা। এই ফৎৎরংযু জয়ারা নিজের চোখে দেখেছেন তাদের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা খুব শক্ত হয়ে পড়ছিল। ঠিক তখনি কিছু একটা করার আকুতি অনুভব করেন অর্থী।

একজন চিকিৎসক অর্থী

একজন চিকিৎসক তার লেখাপড়ার অংশ হিসেবেই একটি শপথ নেন। শপথটা এমন হয় যে, যেকোনো মূল্যেই তিনি তার রোগীর সেবা করবেন। আর সেই শপথ সেদিন আবারও মনে মনে আওড়ে নেন অর্থী। বাসা থেকে নেমে পড়েন রাজপথে। এই নেমে আসা মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। যা একজন ডাক্তারের পেশার মূল লক্ষ্য। বাসা থেকে নেমে দেখেন তার ভবনের সকলেই প্রায় নিজে এসে জমা হয়েছেন। সেই ভবনে থাকতেন আরও একজন চিকিৎসক। যার নাম  হৃতিশা আক্তার মিথেন। তার সঙ্গে মিলে অর্থী আলোচনা করেন কিভাবে এই আহত শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা যায়। সিদ্ধান্ত নেন আহতদের অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন। তাদের হাতের কাছে যা যা ছিল সব নিয়ে নিজেদের বাসার গ্যারেজেই শুরু করেন চিকিৎসা। ধানমন্ডির ওই বাড়িটির গ্যারেজের দরজা সেদিন খুলে গিয়েছিল দেশের জন্য লড়তে গিয়ে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবার জন্য। তাদের এমন সিদ্ধান্তে সেদিন সায় দিয়েছিলেন তাদের ভবনবাসীরাও।

গ্যারেজে প্রাথমিক চিকিৎসা

সেদিনের সেই বীভৎসতা মুখে বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। ঘটনার বর্ণনায় উঠে আসে সেদিন কারও পুরো পিঠ জুড়ে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। কারও চোখে গুলি ঢুকে গেছে। কারও শরীরে এমনভাবে গুলি ঢুকেছে, যা বের করা যাবে না। অর্থীদের কাছে গুলি বের করার তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না। হাত দিয়ে যতটা সম্ভব বের করেছিলেন তারা। রক্ত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করছিলেন, ব্যথানাশক (পেইনকিলার) ওষুধ দিচ্ছিলেন। শেষ সময় পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে গেছেন তারা। হাতে যা ছিল তা নিয়েই সেদিন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক চিকিৎসা। এক দুইজন চিকিৎসা নেওয়া পর আস্তে আস্তে অনেকেই ব্যাপারটা জানতে পারেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভিড়। বাড়তে থাকে বিপদও। বিপদ ছিল ওষুধ সংকট। শুধু তা ই নয়, প্রাথমিক চিকিৎসার সরজামও ধীরে ধীরে কমে আসছিল। অন্যদিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়ছিল আন্দোলনকারীদের। পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আহতদের সংখ্যা।

অন্যরকম অভিজ্ঞতা

একজন ডাক্তার দিনের বেশিরভাগ সময়ই রক্ত, ক্ষত এইসব বিষয় নিয়েই থাকেন। কিন্তু আহত ব্যক্তিকে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের ক্ষততে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আবার ঝুঁকির মুখোমুখি হতে যাওয়া দেখাটা নতুন অভিজ্ঞতাই বলা চলে। সেদিন অর্থীরা দেখেছিলেন নতুন তেজি এক তারুণ্যকে। এমন এক প্রজন্ম যারা ভয় পায় না। যাদের কাছে দাবি আদায়ই মুখ্য। তারা আবার রাজপথে গিয়ে আন্দোলনে তাদের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করতে চায়। এই স্পিরিট মুগ্ধ করেছিল অর্থীদের। অর্থী বলেন, ‘সকল ভয়, ক্লান্তি ভুলে একটা জিনিস মাথায় আমার-আমি পেশায় একজন চিকিৎসক, আহত মানুষের সেবা করাই আমার ব্রত।’ সরাসরি আন্দোলনে যেতে না পেরে এভাবেই, থাকার পথ বেছে নেন অর্থী। এভাবে টানা দুদিন গ্যারেজে চলে চিকিৎসা সহায়তা।

মূল প্রতিবন্ধকতা

অনুমতি কোনো প্রতিবন্ধকতা না হলেও অর্থীদের মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল চিকিৎসা সরঞ্জাম। সেদিনগুলোতে এলাকার সব দোকান ছিল বন্ধ। এদিকে নিজেদের কাছে থাকা জিনিসগুলোও শেষ হয়ে আসছিল অর্থীদের। শেষে ওষুধের দোকানদারকে বাসা থেকে ডেকে এনে দোকান খুলিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসা হয়। এই গ্যারেজের কথা শিক্ষার্থীদের কাছে শুনে দ্বিতীয় দিন কিছু মেডিকেল শিক্ষার্থী ভ্যানে করে এনে কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাদের দিয়ে যায়। এ কাজ করায় তাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। ১৩৫ নম্বর বাসার নিচে আন্দোলনকারীরা আছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ এসে ভবনের ভেতরে তাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি গ্রুপ এসে চিকিৎসক অর্থী ও মিথেনের খোঁজ করে এবং হুমকি দিয়ে যায়। তারপরও এ দুই চিকিৎসককে থামানো যায়নি। ১৯ জুলাই কারফিউতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেদিনও তারা তাদের এ সেবা অব্যাহত রাখেন।

নাগরিক অর্থীর স্বপ্ন

অর্থীর চাওয়া নতুন বাংলাদেশ হবে ন্যায় আর সাম্যের। নতুন বাংলাদেশ হবে সমৃদ্ধির, সমতার।  ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি থাকবে না এ দেশের বুকে। অর্থী বলেন, আমি যেহেতু পেশায় একজন ডাক্তার, আমার প্রত্যাশা, এই খাতে অতীতের মতো আর দুর্নীতি যেন না হয়। ডাক্তারদের কর্ম পরিবেশ থাকবে উন্নত। থাকবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষটাও যেন সুচিকিৎসার আওতায় আসতে পারে সেই ব্যবস্থা চাই। চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক হবে মধুর। বিনা চিকিৎসায় এদেশের কোন মানুষ আর মারা যাবে না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − four =