ঢাকা টু কক্সবাজার: জার্নি বাই ট্রেন

প্রভাষ আমিন

সমুদ্র আমার খুব প্রিয়, আমার চেয়ে বেশি প্রিয় আমার স্ত্রী মুক্তি আর আমাদের একমাত্র সন্তান প্রসূনের। আমরা বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে সবার আগে থাকে সমুদ্র। আর বাংলাদেশেই যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, তাই আমাদের খুব বেশি দূরে যেতে হয় না। তবে ব্যাকপেইনে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে কক্সবাজারও আমার কাছে অনেক দূরের গন্তব্য হয়ে গেছে। মাত্র ৪১৪ কিলোমিটার। একসময় মেরিন ড্রাইভে গাড়ি চালানোর লোভে গাড়ি নিয়ে চলে গেছি যখন তখন। কিন্তু এখন গাড়ি চালিয়ে তো দূরের কথা, সড়ক পথে অত লম্বা পথ যাওয়াই বারণ। বিমানে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাই কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করতে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। ব্যাকপেইনের কারণে আমার সড়ক পথে ভ্রমণ নিষেধ। তবে নৌ, বিমান ও রেলপথে ভ্রমণে আপত্তি নেই। ঢাকা-কক্সবাজার সড়ক পথে সম্ভব নয়, আকাশ পথে সামর্থ্য নেই, নৌ পথে সম্ভব নয়; বাকি থাকলো রেলপথ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে যাওয়া যায়। অনেক দিন ধরেই শুনে আসছিলাম চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে ঢাকা থেকে আরামে ট্রেনে ঘুমাতে ঘুমাতে কক্সবাজার যাওয়া যাবে। সত্যি সত্যি কু ঝিক ঝিক ট্রেনের সিøপিং বার্থে ঘুমানোর চেয়ে আরামের আর কিছু নেই।

অনেক স্বপ্নের কথা শুনি। অর্ধেক বিশ্বাস করি, অর্ধেক করি না। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। নিজেদের পয়সায় পদ্মা সেতু করে তিনি প্রমাণ করেছেন অসম্ভব বলে কিছু নেই। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের পর আমি লিখেছিলাম, ‘পদ্মা নেতু: শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমির প্রতীক’। সত্যি শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমির কারণেই বাংলাদেশ উন্নয়নের রাজপথে এগিয়ে চলছে দারুণ গতিতে। ব্যাপারটি ঠিক ভালো নয়, তবু বাংলাদেশে সবকিছুতে সবাই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান। কারণ সবাই জানেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু দ্রুত হবে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, এই সময়ে শেখ হাসিনার কারণে আরো অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু পর্যন্ত যাওয়ার যে রাস্তা, মানে এক্সপ্রেসওয়ে, তাতে উঠলে মনেই হয় না বাংলাদেশে আছি। পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলেও স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। বিদেশে গিয়ে যখন কোনো এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেছি, মনে একটা আফসোস হতো, ইশ আমাদের দেশে যদি এমন একটা রাস্তা হতো। অত লম্বা না হলেও বাংলাদেশ এক্সপ্রেসওয়ে যুগে প্রবেশ করেছে, তাও কম নয়। আপাতত না হয় দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটলো। তবে আমরা যেহেতু একবার এক্সপ্রেসওয়ে চিনে গেছি, আমি নিশ্চিত আরো বড় বড় এক্সপ্রেসওয়ের দেখাও আমরা পাবো। ঢাকা-চট্টগ্রাম একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নিদেনপক্ষে একটি এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের অর্থনীতির গেমচেঞ্জার হতে পারে।

এই যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা লিখলাম, এটাও কিন্তু আর স্বপ্ন নয়। ঢাকায় বিস্তৃত নেটওয়ার্কের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। আপাতত ফার্মগেট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের অংশ চালু হয়েছে। তাতেই কিন্তু পরিবর্তনটা চোখে লাগছে। ফার্মগেট থেকে ১০ মিনিটে বিমানবন্দর এতদিন শুধু স্বপ্নেই যাওয়া যেতো। এখন সেটা বাস্তবেও সম্ভব।

আরেকটা বিষয় আমার কাছে এখন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। সেটি হলো মেট্রোরেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ হয়েছিল। তবে সেটা নিছকই অভিজ্ঞতা। তবে দিল্লী মেট্রো আমার অভিজ্ঞতাকেই বদলে দিয়েছে। আমি যতবার দিল্লী গেছি, মেট্রোর পুরো সুবিধা নিয়েছি। মেট্রোতে সময় বাঁচে, অর্থ বাঁচে, আরাম হয়। বাংলাদেশেও মেট্রো এখন বাস্তবতা। উত্তরা থেকে মতিঝিল এসে কাজ সেরে দুপুরে বাসায় ফিরে লাঞ্চ করা যায়। এটা কে কবে ভেবেছিল।

২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকের বৈঠকে যখন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পায়, তখনও আমার কাছে ব্যাপারটি স্বপ্নই মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এমন অনেক প্রকল্পই নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের ব্যয় ও সময় দুটিই বেড়ে যায়। প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখে না। কিন্তু সময় একটু বেশি লাগলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন যোগাযোগের লাইন এখন ক্লিয়ার। গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন। বন্যায় রেললাইন বেঁকে না গেলে হয়তো আরো আগেই লাইনটি ক্লিয়ার থাকতো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কথা দিয়েছিলাম, কথা রাখলাম। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ হলো। রেল সংযোগে অন্তর্ভুক্ত হলো দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার। তাতে আমিও আনন্দিত। মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রেললাইন নির্মাণ করার। সেই রেললাইনের উদ্বোধন হলো আজ।’ কথা রাখায় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন।

কক্সবাজারে একটি চমৎকার আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। আমি এখনও সরাসরি দেখিনি। ছবি দেখেই মুগ্ধ। যারা দেখেছেন, তারাই ঝিনুক স্টেশনকে তুলনা করছেন ইউরোপের কোনো স্টেশনের সাথে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়াতে ২৯ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের দৃষ্টিনন্দন ছয়তলা ভবনের এই রেলস্টেশন। যেখানে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, শিশুযত্ন কেন্দ্র, পোস্ট অফিস, কনভেনশন সেন্টার, ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থান, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা।

সবকিছু ঠিক থাকলে ১ ডিসেম্বর থেকে সবাই ট্রেনে চড়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পথে যে ট্রেন চলাচল করবে এর জন্য রেল কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে ট্রেনটির নাম কক্সবাজার এক্সপ্রেস চূড়ান্ত করেছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে ট্রেন ছাড়বে রাত সাড়ে ১০টায়। কক্সবাজারে পৌঁছানোর কথা সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে। অর্থাৎ এই ট্রেনটির রানিং টাইম বা চলাচলের সময় ধরা হয়েছে ৮ ঘণ্টা ১০ মিনিট। ট্রেনটি কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসবে বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে। ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে রাত ৯টা ১০ মিনিটে। ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনের শোভন চেয়ারের ভাড়া ধরা হয়েছে ৬৯৫ টাকা। এই পথে এসি চেয়ারের ভাড়া পড়বে ১ হাজার ৩২৫ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৯০ টাকা। আর ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতি যাত্রীকে ভাড়া দিতে হবে ২ হাজার ৩৮০ টাকা। তার মানে চাইলে ৬৯৫ টাকায় কক্সবাজার চলে যাওয়া যাবে।

ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার এক স্বপ্নপূরণের মতই। চাইলেই এখন ঢাকা থেকে ট্রেনে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কক্সবাজার চলে যাওয়া যাবে। ঘুম ভাঙ্গবে সমুদ্র সৈকতে। মনে হতে পারে স্বপ্নেই আছি। সৈকতের শহরে বাজবে ট্রেনের হুইসেল।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − seven =