তিলোত্তমা ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী নগরী

সালেক সুফী: বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মন্ত্রী-সরকারি কর্মকর্তাদের বাণী কথন দেখে কখনো কখনো মতিভ্রম হয় বাংলাদেশকে যেন নতুন স্বর্গ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক গবেষণা আর অনুসন্ধানে ঢাকা এখন বসবাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে অনুপযোগী শহর। ঢাকা সবচেয়ে বায়ু  দূষণের শহর, সবচেয়ে যান জট, জলজটের শহর। আমার জন্ম বরিশালে হলেও, শৈশব কৈশোরের বড় অংশ কেটেছে ফরিদপুরের শ্যামল ছায়ায়।  ঢাকায় যাতায়াত ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ৩২ বছর অন্তরঙ্গ ভাবে দেখেছি  ঢাকাকে।  বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ২০০৫ থেকে প্রবাসে থাকলেও নানাভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত আছি। দেশের সাফল্যে পুলকিত হই, ব্যর্থতায় কষ্ট পাই। আমরা যে মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম। অনেক বন্ধু, স্বজন হারিয়েছি ১৯৭১এ।

আজ যে ঢাকার এতো কলঙ্ক  সেটি শুনে অনেক কষ্ট লাগে। ৭৫ লক্ষ্ থেকে বড় জোর ১ কোটি মানুষ ধারণ ক্ষমতার ঢাকা মহানগরী  এখন ২ কোটির বেশি মানুষ নিয়ে হাঁশফাঁস করছে। নির্মল বায়ু  প্রবাহের পথ সংকুচিত, মৃত প্রায় খাল বিল নদি নালার জল দূষিত, বাতাসে সালফার, কার্বন, শিশা, ধুলিকণায় সিলিকন। ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা। সামান্য বর্ষণেই ঢাকায় জলজটে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অথচ মিডিয়ায় উর্বর মাথার বিজ্ঞজনরা কত মিষ্টি কথা বলেন অহরহ।

পেশাদারী জীবনে সুযোগ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকার অন্তত ৪০টি মহানগরীতে থাকার এবং ঘুরে দেখার। মেলবোর্ন, ক্যালগারি, আমস্টারডাম, রোম, এথেন্স, ব্রুসেলস, ক্যানবেরা, লন্ডন, প্যারিস, লুজার্ন, ডুসেলডর্ফ, টোকিও, সিঙ্গাপুর, বালি, নয়া দিল্লী, আগ্রা, কাবুল, দুবাই, দোহা, কুলালামপুর, ব্যাংকক, হংকং, ওয়াশিংটন, মেক্সিকো সিটি, দারুস সালাম শহর দেখার সুযোগ হয়েছে।

সহজেই বুজতে পারি দুনিয়ার সেরা শহর গুলোর সঙ্গে আমাদের ঢাকার ব্যাবধান কোথায়? দুনিয়ার অধিকাংশ শহর একটি নদীকে মাতা ধরে বিকশিত হয়েছে। আমাদের ছিল চার চারটি নদী। ভেনিস, আমস্টারডাম নগরীর প্রাণস্পন্দন নগরীর বুক চিরে বাহিত খালগুলো। আমাদের নদী-খালগুলো জবর দখলে মৃতপ্রায়। নগরীর বিরাট অংশ জুড়ে পিলখানা, পুরানো বিমান বন্দর, ঢাকা সেনানিবাস। এগুলো স্থানান্তর করা কারো পক্ষে অসম্ভব। ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা গার্মেন্টস কারখানা, ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। এই শহরে যানজট সহসা মিটবে না।

কিছুদিন আগে ঢাকা ওয়াসার মূল্যবান ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একটি ডিজিটাল অনুষ্ঠানে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের কথা বলেছিলাম।  তিনি জানালেন দরকার নেই। অথচ ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে ভয়াবহ ভাবে। ঢাকার মাটির নিচে জালের মতো বিস্তৃত সহস্র ছিদ্র হয়ে পড়া গ্যাস বিতরণ পাইপ লাইন। মধ্যম আকারের ভূমিকম্প হলে ‘টাওয়ারিং  ইনফারনো’ হয়ে যাবে আমাদের প্রাণের নগরী। দূর থেকে দেখে শুনে কষ্ট হয়।

করোনার আগে বছরে অন্তত  দুইবার বাংলাদেশে ফিরেছি শেকড়ের সন্ধানে। ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিরাট একটা অংশে জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাণে সম্পৃক্ত থেকেছি মাঠকর্মী হিসাবে। জানি দেশে পরিকল্পনামাফিক অবকাঠামো নির্মাণে চ্যালেঞ্জগুলো। অনেক সুপারিশ করেছি। অনেক লিখেছি।  বাংলাদেশে দেশপ্রেম এখন কোথায় যেন বন্ধি হয়ে আছে। অনেক মন্ত্রণালয়, অনেক বিভাগ, অনেক সিনিয়র সচিব, অনেক আমলা।  কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সোনার ছেলেরা কোথায় যেন ঘুমিয়ে। দেখতে দেখতে একটি প্রাণের শহর কংক্রিটের বস্তি হয়ে গেলো। সবাই থেকেও কেউ যেন দেখার নেই।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − 1 =