দাপুটে অভিনেতা মাসুদ আলী খান

খ্যাতিমান অভিনেতা মাসুদ আলী খান। টেলিভিশনের অনেক কালজয়ী নাটক, চলচ্চিত্র, বেতার ও মঞ্চে অভিনয় করেছেন দীর্ঘদিন। তবে অনেক দিন থেকেই আড়ালে তিনি। এবার একুশে পদক পেয়েছেন গুণী এই অভিনেতা। তার পুরস্কার প্রাপ্তি নতুন করে সবার সামনে হাজির করেছে তাকে। বয়স বেড়েছে তাই ঘরেই কাটছে তার নিত্যদিন। এমন একজন গুণী মানুষকে কী সহজে ভুলে যাওয়া যায়! সম্প্রতি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রঙবেরঙ পত্রিকার সম্পাদক আফরোজা আখতার পারভীন। এই সাক্ষাৎকারে এমন সব বিষয় উঠে এসেছে যেসব জানলে পাঠক মুগ্ধ হবেন। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন মাসুম আওয়াল।

এক জীবন অভিনয় করে গেছেন। এই কাজের জন্য একুশে পদক প্রাপ্তির অনুভূতি কেমন ছিল?
আমি খুব খুশি হয়েছি। কৃতজ্ঞ সবার কাছে। সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সহকর্মীদের কাছেও কৃতজ্ঞ। আমার নাম জানার পর এক এক করে অনেক সহকর্মী ফোন করেছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন, ভালো লেগেছে।

এক দেড় দশক আগেও বাংলাদেশের নাটকে একটা অন্যরকম আবহাওয়া থাকতো। সবাই অধীর আগ্রহে নাটক দেখার জন্য টিভি সেটের সামনে অপেক্ষা করত। এখন তেমন নাটক হচ্ছে না কেন?
কেন তেমন নাটক হচ্ছে না ভাবলে কষ্ট হয়। আবার তার কারণটাও বুঝি। হুমায়ুন আহমেদ চমৎকার সব নাটক উপহার দিয়েছেন। তার গল্পও ছিল চমৎকার। এখন ভাবার সময় শেষ। এখন যারা নাটক তৈরি করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যিনি লিখছেন তিনিই পরিচালক। সেটা সব সময় শিল্প-সম্মত হয় তা-ও নয়। তারা তাদের পছন্দ মতো নাটক বানাচ্ছেন। ছোট ছোট বাচ্চারা, ইয়াংরা যে জিনিস চাই সেই ধরনের নাটক তারা তৈরি করছেন। নাচ গান করছে। আবার বিয়ে বাড়িতেও দেখা যাচ্ছে নাচ-গান হয়। হিন্দি কালচারটা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর প্রথম কিছুদিন বাঙালি ভাবধারাটা বজায় ছিল। তারপর আবার আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেছে।

দেশের প্রথম নাটক দল ড্রামা সার্কেল। এই বিষয়ে বিশেষ কিছু বলবেন?
ড্রামা সার্কেল ছিল ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক। বেশির ভাগ পরিচালক ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। মনির চৌধুরীর মতো মানুষরা ছিলেন এটার পেছনে। আর ছাত্ররা ছিল শেষবর্ষের। আমরা ছিলাম ইউনিভার্সিটির বাইরের। ১৯৫৬ সালে আমি ড্রামা সার্কেলে জয়েন করেছি। আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলাম; এটা অনেকে মনে করেন। এ তথ্যটি ভুল। ড্রামা সার্কেলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, মুনির চৌধুরী। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বদরুদ্দিন, মকসুদুস সালেহীন।

আপনার অভিনীত প্রথম মঞ্চনাটক কোনটি?
এটা বলা কঠিন। কারণ আমি নাটক করি স্কুলে পড়ার সময় থেকে। প্রতি বছর স্কুলে বার্ষিক নাটক হতো। তখন প্রত্যেক স্কুলে বছরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। নাটক হতো। আমাদের গ্রামের স্কুলেও নাটক হতো।

অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন কী ছোটবেলা থেকেই দেখতেন?
তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি। বাবা কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ছবি দেখাতে। সেই সময়ে ঢাকায় এসেছিলাম চাচার সঙ্গে। ঢাকায় এসে ‘জীবন মরণ’ সিনেমা দেখি। তখন তো ঢাকা এরকম ছিল না। ওই যে সিনেমা দেখলাম ছেলেবেলায়, তারপর থেকেই মনে গেঁথে গেল। অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা তখনই জাগে। তারপর স্কুলে নাটক করি। আরও পরে ঢাকায় এসে অভিনয় শুরু করি। একটা জীবন কেটে গেল অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে।

আপনার নাটকে আসার পেছনে অনুপ্রেরণা কে?
আমার স্কুলের শিক্ষক সুখময় রায়ের কাছে প্রথম নাটকে অভিনয় করার অনুপ্রেরণা পাই। সেই সময় হিন্দু মুসলমান সব ধরনের ছাত্র-ছাত্রী একসঙ্গে এক স্কুলে পড়তাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আমরা সবাই একসঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করেছি।

আপনার অভিনীত প্রথম টিভি নাটক কোনটি?
‘ভাই ভাই সবাই’ আমার প্রথম অভিনীত টিভি নাটক।

আপনার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র কোনটি?
চলচ্চিত্রে আমার প্রথম অভিনয় করা ১৯৬৪ সালে। সিনেমাটির নাম ছিল ‘নদী ও নারী’। ‘নদী ও নারী’ সিনেমায় কাজী খালেক সাহেব ছিলেন। নায়িকা ছিলেন ড. রওশন আরা। পদ্মার চরে শুটিং হয়েছিল। খালি গায়ে শুটিং করার স্মৃতি মনে পড়ে। নিজামতউল্লাহ ছিলেন। পদ্মার চর গড়ে আবার ভেঙে যায়। মুক্তির পর গুলিস্তান হলে দেখেছিলাম। নিজেকে দেখে মনে হয়, অভিনয় আরেকটু অন্যরকম করা দরকার ছিল।

অভিনয় থেকে দূরে আছেন, কষ্ট হয় কি?
না। শিল্পী হিসেবে কোনো আফসোস কাজ করে না। অভিনয়শিল্পকে কিছু দিতে পারছি না, এটাই দুঃখ। এখন অভিনয় করতে পারি না, কষ্ট হয়। এখন শুধু অভিনয় দেখি। নাটক বেশি দেখি।

এখন কোন নাটকগুলো দেখেন?
বিশেষ বিশেষ অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাটক দেখি। সুবর্ণা মুস্তফা, আফসানা মিমি, ফেরদৌসী রহমান এই ধরনের তারকাদের নাটক দেখি।

দেশে সিনেমা আর্কাইভ আছে কিন্তু নাটকের আর্কাইভ নেই…
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। আমাদের ফিল্মের আর্কাইভ আছে; আমি মনে করি নাটকের আর্কাইভ থাকা উচিত। অনেক ভালো ভালো নাটক আছে যেগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কারণ ভবিষ্যতে তারা এসব নাটক দেখে বুঝতে পারবে জানতে পারবে, এক সময় কত ভালো ভালো নাটক নির্মাণ হয়েছে। তারা সে নাটক থেকে শিক্ষা নিতে পারবে।

ছোট থেকে অভিনয় করেছেন। পরিবার থেকে কখনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
সুন্দর প্রশ্ন করেছো তুমি। একসময় মুসলমান ছেলেমেয়েদের অভিনয়ে আসতে দেওয়া হতো না। হারাম বলা হতো। আমার বাড়ির পরিবেশ অবশ্য তেমন ছিল না। আমাকে অভিনয়ে আসতে কেউ বাধা দেয়নি। আমাদের গ্রামেও তেমন কোন সমস্যার সম্মুখীন হইনি। আমাদের সময় যেমন ধর্মের চর্চাও ছিল তেমনি আমরা অভিনয়ও করেছি। গ্রামে আমাদের বাড়ির সামনেই একটা মসজিদ ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই মসজিদ তৈরি করার জন্য জমিটি দান করেছিলেন।

আপনাদের সময় মঞ্চ নাটকের স্বর্ণযুগ ছিল। সেসব দিনের কথা বলবেন?
আমাদের ‘ড্রামা সার্কেল’ তৈরির সময় কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল যারা নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে দিত। অনেক দৃশ্য সেট করা হতো মঞ্চের পেছনে। পরে আসলো নাটকের সেট তৈরির দল। তারা বিভিন্ন নাটকের সেট তৈরি করে দিত। তবে ড্রামা সার্কেলের সেট ড্রামা সার্কেল নিজে তৈরি করত।

‘গ্রুপ থিয়েটার’ নিয়ে কিছু বলবেন?
‘গ্রুপ থিয়েটার’ তৈরি হয়েছিল ড্রামা সার্কেল থেকে। অনেক নাটকের মানুষ তৈরি করেছে তারা। এখনো মঞ্চনাটক হয়। শিল্পকলায় দুইটা হলে নাটক চলে। সেখানে এখনো নাটক দেখছে দর্শকরা। নতুন নতুন নাটক তৈরি হচ্ছে।

ড্রামা নিয়ে ভার্সিটিতে কোর্স শুরু হয়েছে। আপনার মতামত জানতে চাই…
সেখান থেকেও অনেকে শিখছে। আবার এমনও শুনেছি অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টে চান্স না পেয়ে অনেকে এ বিভাগে ভর্তি হচ্ছে। কিছুদিন যাওয়ার পর অবশ্য তাদেরও ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। তারা অভিনয় শিখছে, নির্মাণ শিখছে এবং ভালোবেসে নাটকের সঙ্গে অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

আগে তো প্রযুক্তি ছিল না, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার ছিল না, চিঠির চল ছিল। চিঠি লিখেছেন কখনো কাউকে?
চিঠি লিখেছি, এখন আবার প্রশ্ন করো না যে কাকে চিঠি লিখেছেন। হা হা হা এখন চিঠি লিখি না।

এখনতো হাতে অফুরন্ত অবসর। অবসরে কি করেন?
অবসরে গান শুনি। সেমি ক্লাসিকাল। মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখি, নাটক দেখি, খবর দেখি।

তারকাদের জন্মদিনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারিখ মেলে না। আপনার জন্মদিন নিয়ে জানতে চাই?
সে সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করে দিতেন বড়রা। তারা বয়স কমিয়ে দিতেন। আর ১ তারিখ করে দিতেন। ০১.১২.১৯৩১ আমার সার্টিফিকেটের জন্মদিন। কিন্তু আমার আসল জন্মদিন ০৬.১০.১৯২৯। আমি তো অনেক পুরনো লোক। ভারতবর্ষ দেখেছি। পাকিস্তান দেখেছি। তারপর বাংলাদেশ দেখছি।

অভিনয়ের প্রাইভেট ইনস্টিটিউট হওয়া উচিত কি না?
এখনো ছেলে মেয়েরা ভাবে নাটক করে ভাত পাওয়া যাবে না। তাই তারা অন্য বিষয়ে পড়তে যায়।

ওটিটি দেখেন?
ওটিটি কি? এর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই।

একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি কেন কাচ্চি খেতে বেশি পছন্দ করেন?
হা হা হা আমি আসলেই কাচ্চি খেতে বেশি পছন্দ করতাম। এখনো পছন্দ করি। কিভাবে যে কাচ্চি এত প্রিয় হয়ে গেলো!

জানতে চাই আপনার জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কতটুকু মিলেছে?
জীবনে যা কিছু করেছি ভালোলাগা থেকেই করেছি। কখনো পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আর আমার অনেক বন্ধু ছিল যারা কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের সঙ্গে নিজেকে কখনো মেলাইনি। কখনো নিজেকে ছোট মনে করিনি। হীনমন্যতায় ভুগিনি। আমার মনে হতো, আমি যেটা পারি সেটাও তো অনেকে পারে না।

এখন আপনার সারা দিন কিভাবে কাটে?
কখনো খুব সকালে উঠি। কখনো বেলা করে উঠি, দশটায়। সেটা কাজের উপর নির্ভর করে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করি। পত্রিকা পড়ি। তারপর বেলা হলে বাড়িতে হাঁটাহাঁটি করি। দুপুরের আগে গোসল করি। দুপুর বেলায় খাবার খাই। তারপর আবার টেলিভিশনের সামনে বসি। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখি। এইভাবেই চলতে থাকে।

তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
যে কাজটিই করবে মন দিয়ে করবে। ভালো কাজ টিকে থাকে অনেক দিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আলাপচারিতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one − one =