দুই বাংলায় দুই তারকার বিদায়

রোজ অ্যাডেনিয়াম

মিডিয়া জগতের আকাশ শূন্য করে এক মাসেই বিদায় নিলেন দুই তারকা। গত ২৯ জুন না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলাদেশের নন্দিত অভিনেত্রী মিতা চৌধুরী। অন্যদিকে গত ২৫ জুন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে উড়াল দিয়েছেন কলকাতার নন্দিত ব্যান্ড ‘মাহিনের ঘোড়াগুলি’র প্রিয় শিল্পী তাপস দাস ওরফে বাপি দা। দুই তারকার বিদায়েই শোকাহত হয়েছে মিডিয়া অঙ্গনের মানুষ ও তাদের ভক্তরা। তাদের মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছে রঙ বেরঙ।

ঢাকার মেয়ে মিতা চৌধুরী

মিতা চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৮ সালের ২২ জানুয়ারি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে। তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আমিনুল হক চৌধুরী, মা নূর-ই আক্তার বানু গৃহিণী। মা-বাবার অনুপ্রেরণায় নিজেকে অন্যরকম ভাবে গড়ার সুযোগ পেয়েছেন মিতা চৌধুরী। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় যেমন ভালো ছিলেন তেমনই শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাতেও ছিলেন এগিয়ে।

মেধা তালিকায় প্রথম মিতা চৌধুরী

মেধাবী এই অভিনেত্রী শিক্ষাজীবনেও সফল ছিলেন। তিনি লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি এইচএসসিতে মেয়েদের মধ্যে মেধাতালিকায় প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন।

স্কুল জীবনের নাট্যজগতে প্রবেশ

দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নাট্যজগতে কাজ শুরু করেন মিতা চৌধুরী। তিনি একসময় বিটিভিতে অভিনয় করতেন আর বেতারে খবর পড়তেন এবং ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন।

মিতার যতো আলোচিত কাজ

বিটিভিতে মিতা চৌধুরীর প্রথম নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর ‘আরেকটি শহর চাই’। প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘শান্ত কুটির’। ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকটির পর মিতা চৌধুরীর আলাদা অবস্থান তৈরি হয়। ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে মিতা চৌধুরীর চরিত্রের নাম ‘লিলি’। ‘নন্দিত নরকে’ তার অভিনীত আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। শুধু টিভি নাটকই নয়, মঞ্চে ‘সূচনা’ ও ‘গুড নাইট মা’-এর মতো প্রযোজনায় নিজেকে জড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে ‘অমানুষ’ নাটকে মামুনুর রশীদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। মিতা চৌধুরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘বিষ’, ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। অভিনয়ের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যকার মারশা নরম্যানের ‘নাইট মাদার’ অবলম্বনে মিতা চৌধুরী ‘গুড নাইট মা’-এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন মিতা।

দীর্ঘ সময় প্রবাসে অতঃপর ফেরা

সত্তর-আশির দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। মাঝে ২০০৬ সালে দেশে ফিরে নাটকে কাজ করেছিলেন। সে যাত্রায় প্রায় ১০ বছর ছিলেন ঢাকায়। এ সময় তাকে দেখা গেছে ‘ডলস হাউস’, ‘যোগ-বিয়োগ’ ইত্যাদি নাটকে। আবার ফিরে যান লন্ডনে, সেখানেই শেষ হয় তার বর্ণাঢ্য জীবন।

স্বপ্নের শহরে মৃত্যু

অবশেষে স্বপ্নের শহর লণ্ডনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন মিতা চৌধুরী। নন্দিত এই অভিনেত্রী গত ২৯ জুন ২০২৩ সালে মারা যান। জানা গেছে, লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিতা চৌধুরী মারা গেছেন। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর সময় এ অভিনেত্রীর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। লন্ডনেই তার দাফন সম্পন্ন হয়।

মিতার পরিবার

মিতা চৌধুরী নামে পরিচিত হলেও তার পারিবারিক নাম ছিলো মিতা রহমান। মিতা চৌধুরী দুই সন্তান; দুই ভাই কাইজার চৌধুরী, সিজার চৌধুরীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে ক্যানসারে মারা যান মিতা চৌধুরীর স্বামী শহীদুর রহমান।

মিতার মৃত্যুতে তারকাদের শোক

মিতা চৌধুরীর মৃত্যুর খবর শুনে শোক প্রকাশ করেছেন নন্দিত অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফাসহ অনেকে। সুবর্ণা মুস্তাফা প্রয়াত অভিনেত্রী মিতা চৌধুরীর সঙ্গে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে কাজ করেছিলেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মিতাকে স্মরণ করছি। আমার প্রথম টিভি নাটক ‘বরফ গলা নদী’ মিতার সঙ্গে ছিল। ‘ডলস হাউস’ নাটকের সুবাদে প্রায় ২৮ বছর পর আমরা ফের পর্দায় এসেছিলাম।’ এর আগে আরেকটি শোকবার্তায় সুবর্ণা মুস্তাফা লিখেছেন, ‘প্রিয় মিতা, আমার সুন্দরী, ভালোবাসার, দুর্দান্ত মেধাবী বন্ধু, তোমাকে বিদায় বলা খুব কঠিন। তুমি তোমার জীবনের ভালোবাসা শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আবারও এক হয়েছে। এটা আসলে শুধু সময়ের ব্যাপার। শান্তিতে থাকো আমার ভালোবাসা।’ মিতা চৌধুরীর ছবি শেয়ার করে নির্মাতা, অভিনেতা কাওসার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমি ভাবতে পারছি না মিতা আপা নেই! মিতা চৌধুরী, প্রিসিলা পারভীন, রিনি রেজা, আল মনসুর, রাইসুল ইসলাম আসাদ ভাইদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। বিস্ময়ে ভাবতাম এত এত জটিল নাটকে এত ‘সহজ অভিব্যক্তি’ও কি সম্ভব পারফরমারদের পক্ষে! তাদেরই একজন হারিয়ে গেলেন মুহূর্তেই! আমি ভীষণ মর্মাহত! মিতা’পার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।’

তাপস দাস অর্থাৎ সবার প্রিয় বাপি দা

ভালোবাসি জোছনায় কাশবনে ছুটতে,/ছায়াঘেরা মেঠোপথে ভালোবাসি হাটতে,/ দূর পাহাড়ের গায়ে গোধুলীর আলো মেখে,/ কাছে ডাকে ধানক্ষেত সবুজ দিগন্তে,/ তবুও কিছুই যেনো ভালো যে লাগে না কেন,/ উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন,/কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও?/ ভালোলাগে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ভাসতে,/ প্রজাপতি বুনোহাস ভালো লাগে দেখতে,/ জানলার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে,/ ভালোবাসি এক মনে কবিতা পড়তে,/ তবুও কিছুই যেনো ভালো যে লাগে না কেন,/ উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন,/কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও?/ যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে,/ শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝড়ায় মাঠে প্রান্তরে/ তখন ভালো লাগে না, লাগে না কোন কিছুই/ সুদিন কাছে এসো, ভালো বাসি একসাথে সবকিছুই/ ভালোবাসি পিকাসো, বুনোয়েল, দান্তে,/ বিটলস, ডিলান আর বিথোফেন শুনতে,/ রবি শঙ্কর আর আলি আকবর শুনে/ ভালোবাসি ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে,/ তবুও কিছুই যেনো ভালো যে লাগে না কেন,/ উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন,/কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও?/ যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে,/ শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝড়ায় মাঠে প্রান্তরে।/ তখন ভালো লাগে না, লাগে না কোন কিছুই/ সুদিন কাছে এসো, ভালো বাসি একসাথে সবকিছুই।/ ভালো গান শুনতে ভালোবাসেন অথচ এই গানটি শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এই গানটিরই জনক ছিলেন তাপস দাস অর্থাৎ বাপি দা। নন্দিত ব্যান্ড দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

বাপি দা’র জন্ম ও বেড়ে ওঠার গল্প

তাপস দাস অর্থাৎ বাপি দা ১৯৫৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ভারতে এক বাঙালি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নারায়ণ চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম জ্যোৎস্না দাস। এই পরিবারের চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। ছোট বয়স থেকেই বাপির সংগীত জগতে যাত্রা শুরু হয়। তিনি তার মা জ্যোৎস্না দাসকে তার প্রথম গুরু বা শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করতেন। স্ব-শিক্ষিত গিটারবাদক বাপি, তার কলেজ জীবনে এই ছয় তারের যন্ত্রের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করেন। ১৯৭৫ সালে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চ্যাটার্জি, রঞ্জন ঘোষাল, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, এব্রাহাম মজুমদার এবং তপেশ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাপি রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অংশ হন।

বাপি দা’র যতো কাজ

১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে আধুনিক বাংলা গানের ধরন বদলে দিয়েছিল দলটি। এই দলের সবচেয়ে পুরনো সদস্যদের একজন তাপস দাস। যিনি সবার কাছে বাপী দা নামেই পরিচিতি। এই গুণী মানুষটি সংগীত ক্যারিয়ারের যা কাজ করেছেন তার প্রায় সবগুলি কাজই সমাদৃত। যেমন: সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯) এই তিন অ্যালবাম ভারতীয় রক মিউজিকের মাইলস্টোন। আশির দশকের গোড়ায় ব্যান্ড ছেড়ে নিজেদের কর্মজগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সকলে। তবে ১৯৯৫ সালে ফের মুক্তি পায় মহীনের ঘোড়াগুলির ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। এই অ্যালবামেরই গান ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’, যা আজকের জেনারেশনের কাছেও তুমুল জনপ্রিয়। ২০১৫ সালে বাপি মহীন এখন ও বন্ধুরা নামে একটি বাংলা ব্যান্ড গঠন করেন। একই বছরের ৬ অক্টোবর তিনি লগ্নজিতা চক্রবর্তী, মালবিকা ব্রহ্মা এবং তিতাস ভ্রমর সেনের সঙ্গে ‘মহীন এখন’ ও ‘বন্ধুরা’ নামে একটি ইপি অ্যালবাম প্রকাশ করেন। অ্যালবামটিতে পাঁচটি গান এবং মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদর্শনকারী একটি অ্যালবাম রয়েছে।

না ফেরার দেশে বাপি দা

বাপি দা সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন  ২০২৩ সালের ২৫ জুন। হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিলেন তিনি। জানা যায়, তাপস দাস দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন। কলকাতার গায়ক রূপম ইসলাম এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘এরকম কত বাঙ্ময় মুহূর্তই রয়ে গেল শুধু। সচল হয়েই থেকে গেল গানজীবনের অনন্ত পথ চলা থেমে গেল বললে ভুল হবে, মারাত্মক ভুল। বাপিদা- সশরীরে তুমি আর নেই, কিন্তু সর্বত্র এভাবেই তুমি থাকবে। লাল সেলাম। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’

বাপি দা’র ভক্তদের হাহাকার

এই গুণী মানুষটির মৃত্যুদিনে সোশ্যাল মিডিয়া যেন এক শোক বই হয়ে গিয়েছিল। তার ভক্তদের হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। প্রিয় শিল্পীকে বিদায় জানানোর ভাষাগুলো ছিলো এমন, ‘বাপি দা তুমি যেখানেই থাকো ভালো থাকো!’ তোমাদের এই অনন্য সৃষ্টি আজীবন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় গাঁথা থাকবে। আজ তাপস দা নেই কিন্তু তার এই অনবদ্য সৃষ্টি আজীবন থেকে যাবে।

গায়কের হয়তো মৃত্যু আছে, তবে গানের নেই। এই গানের মধ্য দিয়েই হয়তো বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ। এখনো মানতে কষ্ট হচ্ছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র বাপি দা নেই। সব মিলিয়ে সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ভক্তদের।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 − 1 =