দুর্নীতিকে না বলুন

ইমদাদ ইসলাম

দুর্নীতি মানব সভ্যতার প্রাচীনতম অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে । দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানব সভ্যতা বিকাশে এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনে দুর্নীতি প্রধান অন্তরায়। যে সকল দেশে সম্পদের অপ্রতুলতা রয়েছে সেখানে দুর্নীতির ব্যাপকতা রয়েছে। দুর্নীতি এমন এক অপরাধ যা অন্যান্য অপরাধ দমনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অধিকাংশ অপরাধের অন্যতম উৎস হচ্ছে দুর্নীতি।কালের বিবর্তনে দুর্নীতির প্রকৃতি, রূপ, তীব্রতা ও প্রভাব ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এ বিবর্তনের মূলে রয়েছে সম্পদের উপর ব্যক্তির মালিকানা অর্জন এবং মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে অসঙ্গতি। জাগতিক সুখ এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাল্পনিক স্বপ্নে বিভোর কতিপয় মানুষের সীমাহীন লোভ দুর্নীতির অন্যতম কারণ । দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় । বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, দুর্নীতি কেবল গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’। বাংলাদেশের সংবিধান দুর্নীতিযুক্ত ও ন্যায়ানুগ সমাজ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে । স্বাধীন বাংলাদেশেও দুর্নীতি দমনে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’’ নামক প্রতিষ্ঠানটি কর্মতৎপর ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুফল না পাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে ২০০৪ সালে মহান সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ প্রণয়ন করা হয় । এ আইনের ওপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যুরো অব এন্টি করাপশন বিলুপ্ত করে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় । দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। দুর্নীতি দমন কমিশন যে সকল অনিয়ম বা অপরাধের জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে অর্থাৎ দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ সমূহের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি,মানিলন্ডারিং এবং জ্ঞাত আয়ের উৎস বর্হিভূত সম্পত্তির দখল অন্যতম।

কোন সরকারি কর্মচারী তার উপর ন্যাস্ত সরকারি দায়িত্ব  পালনে সবসময় সচেষ্ট থাকবে। অসৎ উদ্দেশ্যে দায়িত্ব পালন না করা বা সাময়িক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকাসহ অন্যকোন কাজের মাধ্যমে নিজে অথবা অন্যকোন  ব্যক্তিকে বা প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া বা দেওয়ার ব্যবস্থা করা এসবই দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ। এখানে সরাসরি আর্থিক বিষয় জড়িত থাকতেও পারে আবার নাও পারে। তথ্য গোপনের মাধ্যমেও অনৈতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। অসাধু বা অবৈধ উপায়ে সরকারি কর্মচারীকে প্রভাবিত করা এবং ব্যক্তিগত প্রভাব প্রয়োগের  জন্য বকশিশ গ্রহণ দুর্নীতি দমন আইনে  অপরাধ। সরকারি কর্মচারীর জন্য  কোন সরকারি কাজ সম্পদনের বিনিময়ে বৈধ পারিশ্রমিক ব্যতীত অন্যকোন পুরস্কার, বকশিশ বা যে কোন সুবিধা  গ্রহণ অবৈধ। সরকারি কর্মচারী কর্তৃক অনুরূপ সরকারি কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত মোকাদ্দমা বা ব্যবসায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট হইতে বিনামূল্যে মূল্যবান বস্তু গ্রহণ করাও অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন ব্যক্তির ক্ষতি সাধনকল্পে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্যকরণ এবং ক্ষতি সাধনকল্পে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক কোন অশুদ্ধ দলিল প্রণয়ন দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলভূক্ত অপরাধ। সরকারি কর্মচারী বেআইনিভাবে ব্যবসায়ে নিয়োজিত হওয়া, বেআইনিভাবে সম্পত্তি ক্রয় বা নিলামের দর হাঁকা এবং কোন ব্যক্তিকে শাস্তি হতে বা কোন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে রক্ষার উদ্দেশ্যে আইনের নির্দেশ অমান্য করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন ব্যক্তিকে শাস্তি হইতে বা কোন সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত হতে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক ভুল রেকর্ড প্রস্তুত করা আইন সম্মত নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে এবং প্রতারণা কারার উদ্দেশ্যে  কোন পুস্তক, পত্র, লিপি, মূল্যবান জামানত  হিসেবে কোন কিছু লিপিবদ্ধ করা বা তা থেকে কোন গুরুত্ত্বপূর্ণ বিবরণ সংযোজন বা বিয়োজন করা বা করতে সহায়তা করাও দুদক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সাধারণভাবে অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদকে বৈধকরণের প্রক্রিয়াকে মানিলন্ডারিং হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । মানিলন্ডারিং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয় । দেশের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করে দেশের বাইরে অর্থ বা সম্পদ পাঠানো কিংবা রক্ষ করা মানিলন্ডারিং এর আওতাভুক্ত । আবার দেশের বাইরে এমন অর্থ বা সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ আছে, কিন্তু তা ইচ্ছাকৃতভাবে আনা হয়নি, তাও মানিলন্ডারিং । অনুরূপভাবে বিদেশ থেকে প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা কিংবা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করা মানিলন্ডারিং আইনে অপরাধ । দেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই।

দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে মানিলন্ডারিং অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট এবং সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা আবশ্যক । এজন্য মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বিষয়ক জাতীয় ঝুঁকি নিরূপণ করা প্রয়োজন এবং ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় এর প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।  মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে । অপরাধের সাথে জড়িত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে । ব্যাংকিং সিক্রেসি আইন মানিলন্ডারিং কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা বিরোধমুক্ত হতে হবে । সকল ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক ও বিধিগতভাবে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের উদ্যোগ থাকতে হবে । কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন লেনদেন হতে যদি অনুমিত হয় যে এসব লেনদেনের সাথে মানিলন্ডারিং অপরাধ জড়িত আছে বা থাকতে পারে তাহলে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে দেশের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক করতে হবে; নির্ধারিত অ-আর্থিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের জন্যে একটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠা, নিয়ন্ত্রণ ও রিপোর্ট করণ পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে । সরল বিশ্বাসে সন্দেহজনক রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আর্থিক এবং অ-আর্থিক সেক্টরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মচারীদেরকে যথাযথ গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে । মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনের ক্ষেত্রে দেয়া নীতিমালা ভঙ্গ বা অমান্যকারীদের জন্যে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে । শেল (Shell) ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা শেল (Shell) ব্যাংকের কার্যক্রম চলমান রাখার বিষয় কোন দেশই অনুমোদন প্রদান না করার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হতে হবে এবং নগদ অর্থ বা বাহকের হস্তান্তরযোগ্য ইন্সট্রুমেন্ট সীমান্ত পারাপারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনা থাকতে হবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি নির্দিষ্ট সীমার অধিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিকট রিপোর্ট করবে; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনের ক্ষেত্রে যেসমস্ত প্রতিষ্ঠানের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেই সেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও লেনদেনের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে ।

আর্থিক ও তালিকাভুক্ত অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পেশাসমূহে যথাযথভাবে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ করার জন্যে উপযুক্ত নিয়ম-কানুন-বিধি প্রতিষ্ঠা করতে হবে; মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিষয়ে সন্দেহজনক রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, তদন্ত পরিচালনা এবং মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান থাকতে হবে । জাতীয় তথ্য সংগ্রহ কেন্দ্র হিসেবে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ)-কে গড়ে তুলতে হবে । আইনি কাঠামো এবং আইন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বচ্ছতা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর পরীক্ষা করা যায়; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনের লক্ষ্যে তদন্ত পরিচালনা, মামলাকরণ এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত কাজগুলো সহজভাবে পরিপালনের জন্য সকল দেশকে পারস্পারিক আইনি সহযোগিতা (Mutual legal Assistance) প্রদান করতে হবে ।

২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত,বৈষম্যহীন উন্নত দেশ বিনির্মাণ করতে হলে দেশের দুর্নীতিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রন করতে হবে।পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও দুর্নীতি আছে,তবে তা নিয়ন্ত্রীত।তাই সর্বক্ষেত্রে সকলকে দুর্নীতিকে না বলতে হবে।

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 5 =