বরুন কুমার দাশ
ফাতেমা বেগম বাস করেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায়। বয়স তার ৫৩ বছর। গ্রামারে বাড়ি জামালপুরের শরিষাবাড়িতে। ফাতেমা পেশায় একজন চা বিক্রেতা। মাস দুয়েক আগে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মুগদা মেডিকেলে চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা শেষে তখন চিকিৎসক জানান তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ফাতেমা বেগম এর আগে কখনোই বুঝতেই পারেননি তার এই সমস্যা থাকতে পারে।
শুধু ফাতেমা বেগম নন; উচ্চ রক্তচাপ থাকা ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ জানেন না তাদের সমস্যার কথা। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে দেশে উচ্চরক্ত চাপ থাকা ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ৬৭ শতাংশ পুরুষ ও ৫১ শতাংশ নারীই জানেন না তাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা। নীরব ঘাতক।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- উচ্চরক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। শুধু উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ৮০ শতাংশ স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটার্ক প্রতিরোধ সম্ভব। ১৮ বছরের পর থেকেই প্রতিবছর ব্লাড পেশার মেপে দেখা যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপি-ের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যধিক উচ্চ রক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হল চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জোয়াদ্দার বলেন, ১৮ বছর বয়সে ব্লাড পেশার মাপবেন। যদি দেখেন নরমাল। ছয়মাস এক বছরের মধ্যে মাপতে হবে না। একবছর পরে আবার মাপবেন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (এনসিডি) ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, ‘কনসেপ্টটা এরকম যে একটা রাষ্ট্র তার প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠিকে বছরে একবার চেক করবে যে তার পেশার আছে কিনা? তার ব্লাড সুগার কত, তার কোলেস্টেরল কতো? এডলান্ট জনগোষ্ঠীর ডেফিনেশন কি? ১৮ থেকে আরম্ভ করে উর্ধ্বে পর্যন্ত। এই পার্টিকুলার প্রোগ্রামের জন্য এই কাট অব পয়েন্টটা রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে তার পকেটে কতো টাকা আছে তার উপর। যদি অনেক টাকা থাকে আপনি আঠারোতে করেন, যদি আরেকটু কম টাকা থাকে আপনি ত্রিশে করেন। যদি আরো কম টাকা থাকে আপনি ৪০ বছর কাট অব পয়েন্ট করেন।’
তিনি বলেন, বর্তমানে সরকার যে পলিসি নিয়েছেন তাতে ওনারা কার্ট অব পয়েন্ট নির্ধারণ করেছেন ৪০ বছর। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাইরেক্টার জেনারেল অব হেলথ সার্ভিস যে প্রোগ্রামটা নিয়েছেন আস্তে আস্তে এটা এক্সপ্যান্ড করছে। সিলেটে, ময়মনসিংহ কক্সবাজারসহ আরো কিছু জায়গায় এক্সপ্যান্ড করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে ৪০ বছর তর্দুধ্ব জনগোষ্ঠী আছে তাদের সবাইকে বছরে একবার স্ক্রীন করা। স্ক্রীন করে যাতে ভালো পাওয়া যাবে, তাদের আবার এক বছর পরে আসতে বলা হবে। আর যাতের ব্লাড পেশার বেশি পাওয়া যাবে তাদের প্রোটোকল অনুযায়ী চিকিৎসার মধ্যে নিয়ে আসা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেতো। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চামচ।
ঘরে লবণ খাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবারের সদস্য হিসেবে তরকারিতে ঠিক ক’চামচ লবণ দেয়া দরকার, তার বেশি নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, যা ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখ। তাই বিশেষজ্ঞরা স্কিনিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে। তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয় সে হিসেবে কি কি লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা বলবো। প্রথম কাজ হচ্ছে সবাইকে স্কিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।
‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ কোনো ওষুধ সেবন করে না।
গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ।
ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।
বাসস