নগর দরিদ্রদের জন্য রাজউক-এর কোন পরিকল্পনা নেই: অধ্যাপক নজরুল ইসলাম

রবিবার, ২ জুন  ডেইলী স্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজিনাস নলেজ (বারসিক) এবং কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) এর যৌথ আয়োজনে “নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জ্বালানী ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানী গ্রহণে চ্যালেঞ্জ: প্রেক্ষিত ঢাকা মহানগরী” শীর্ষক একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এর সভাপতিত্বে উক্ত জাতীয় সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী, স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নওজিয়া ইয়াসমিন এবং বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর এনার্জি, ইনভেস্টমেন্ট গ্রান্টস এবং ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্সের অ্যাটাচি – প্রোগ্রাম ম্যানেজার কিয়ারা ভিদুসি। সংলাপটিতে মূল প্রবন্ধ প্রদান করেন বারসিক এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মো. কামরুজ্জামান এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বারসিক এর নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বস্তিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি প্রথমে বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। নগর দরিদ্রদের জন্য রাজউক এর কোন পরিকল্পনা নেই। গবেষণার ফলাফলটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কাছে পৌঁছাতে হবে। নগর নীতিমালা তৈরি হয়েছে কিন্তু সেটির কোন বাস্তবায়ন নেই। নগর নীতিমালাতে নগর দরিদ্রদের জ্বালানিসহ অন্যান্য অধিকার বিষয় বলা হয়েছে। তাই এটিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ক্যাপস এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি বায়ুমানের ব্যাপক অবনতির কারণ হতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলার জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, আমরা যখন কোন প্ল্যান করি তখন বস্তিবাসীদেরকে বাদ দিয়েই প্ল্যান করি। নগরের এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আমরা কখনোই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি গ্রহণের যে চ্যালেঞ্জ সেটি আমাদের এই বস্তিবাসীদেরকে নিয়েই মোকাবেলা করতে হবে।

স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নওজিয়া ইয়াসমিন বলেন, আমরা যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছি সেটি পরিবেশে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত করে যেগুলো আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। আমরা যত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছি তত আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে এবং বস্তিবাসীদেরকে আলাদা করে না দেখে তাদেরকে নিয়েই জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব নবায়নযোগ্য জ্বালানি কীভাবে সংরক্ষিত হবে সেটিও ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর এনার্জি, ইনভেস্টমেন্ট গ্রান্টস এবং ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্সের অ্যাটাচি – প্রোগ্রাম ম্যানেজার কিয়ারা ভিদুসি বলেন, আমরা জানি নবায়নযোগ্য শক্তিই ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তিকে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। সকলের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জাতীয় সংলাপের মূল বক্তব্যে বারসিক এর প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকা মহানগীর ৬৪% নগর দরিদ্র পরিবার। রান্না ও বিদ্যুৎ বাবদ গড়ে একটি পরিবার ২৩৮৯ টাকা খরচ করে। অর্থাৎ মোট আয়ের ১৫% চলে যায় জ্বালানি খরচে। গবেষণায় আরও বলা হয়, বিগত দুই বছরের মধ্যে ৮% পরিবারে দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার ৫৪% রান্নার লাকড়ি চুলা থেকে। রান্নার ধোঁয়ার কারণে গত ছয় মাসের মধ্যে ২২% পরিবারের সদস্যদের গুরুতর কাশির সমস্যা হয়েছে। গবেষণায় মাত্র ১০% উত্তরদাতা ‘‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি” শব্দটির সাথে পরিচিত। ঢাকার নগর দরিদ্র পরিবারগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহের অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি) এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বস্তিবাসীদের ফরমাইল হাউজিং নিয়ে আসতে হবে। কারণ ইনফরমাল হাউজিং-এ তাদের এনার্জি সমস্যা সমাধান করা যাবে না। পরিকল্পনায় বস্তিবাসীদের অন্তভুক্ত করতে হবে। ফরমাল একসেস দিতে হবে সোলার ও গ্যাস সংযোগে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর প্রফেসর খসরু মোহাম্মদ সেলিম বলেন, বস্তি এলাকায় বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে আমরা বস্তিবাসীদের জ্বালানী চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারি। এছাড়াও সাশ্রয়ী ও টেকসই সোলার প্যানেল উদ্ভাবনের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য আমাদেরকে সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান টাউন প্ল্যানার মাকসুদ হাশেম বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বস্তিবাসীদের অবদান গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করতে হবে। কারণ অর্থনীতিতে তাদের কোন ভূমিকা না থাকলে তারা টিকে থাকতে পারবে না।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) এর জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ বিষয়ক উপ-পরিচালক ও সিনিয়র সহকারী সচিব জনাব মুহাম্মদ হাসনাত মোর্শেদ ভূঁইয়া বলেন, আমরা সর্বত্র বলছি কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না, সবাইকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের দিকে এগোতে হবে কিন্তু কার্যত আমরা বস্তি বাসিদের পেছনে ফেলেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি যেটা কখনই সম্ভব নয়। আমাদেরকে স্মার্ট টেকনোলজি নিয়ে চিন্তা করতে হবে এবং এটিকে সহজ ও সুপরিচিত করে তুলতে হবে।

সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (এসএসিসিজেএফ) এর এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট কেরামত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই উন্নত দেশ গুলোর সহযোগী হয়ে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

ক্যাপস এর সায়েন্টিফিক অফিসার ইঞ্জি. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী বলেন, নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা জ্বালানি ব্যবহার করে তাদের স্বাস্থ্য সংকট রয়েছে; সেটা হলো বায়োমাসের ফলে তারা বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে। যদি আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করি তাহলে বায়ু দূষণও কমবে। আমরা যদি শিক্ষা-কার্যক্রমে যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয় যুক্ত করি তাহলে এই বিষয়টি তাহলে তারা মেধা-মননে ধারণ করবে এবং পরবর্তীতে বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে।

এছাড়াও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার, ইকো-নেটওয়ার্ক গ্লোবাল এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক শামীম আহমেদ মৃধা, একশন এইড এর ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রসুল, হেলভেটাস বাংলাদেশ এর ডোমেন কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান সহ বক্তব্য রাখেন প্রমুখ। জাতীয় সংলাপে বিভিন্ন বস্তি কমিউনিটির নারীরা তাদের সমস্যাগুলো শেয়ার করেন। কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) এর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সানইয়াত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংলাপটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন। উক্ত জাতীয় সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্যাপস গবেষণা সহকারী, বারসিক এবং কাপ এর প্রতিনিধিগণ সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংস্থার সদস্যবৃন্দ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 5 =