মুশফিকুর রহমান
গত ২ জুলাই ২০২৪ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে ব্যবহারে সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে এক বৈঠকে মিলিত হন। আগামী বছর জাতিসংঘের ইউএনএফসিসিসি-তে বাংলাদেশ তার ‘জাতীয়ভাবে নির্ধারিত কার্বন নিঃসরণ অবদান’ সম্পর্কিত রিপোর্ট জমা দেবে। সে রিপোর্ট জমা দেবার পর আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে তা মনিটর করা হবে। সে পটভূমিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে কার্বন নিঃসরণ সম্পর্কিত কৌশল ও তা বাস্তবায়নের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী আলোচনা। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের ৪০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মেটানোর আয়োজন নিশ্চিত করতে যে গতিতে বিদ্যমান জ্বালানি অবকাঠামোর রূপান্তর ঘটাতে হবে, সেটি বাস্তবায়ন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন’ এর সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আখতার জানিয়েছেন যে, সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আইইইএফএ-এর প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক (বাংলাদেশ) শফিকুল আলম মনে করেন, ২০৪১ সালে ৪০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ২৭-৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০% ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% কার্বন নিঃসরণ কমাবার চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে।
ইতিমধ্যে দেশে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক জ্বালানি মিশ্রণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বর্ধিত ব্যবহারের নানামুখী উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি জানিয়েছেন যে সরকার সৌরবিদ্যুতের বর্ধিত ব্যবহার (রুপটপ সোলার, নেট মিটারিং সুবিধার আওতায় আরও বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও তার ব্যবহার), জলবিদ্যুৎ আমদানি ও ব্যবহার, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির বর্ধিত ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক জ্বালানি সরবরাহে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিশ্চিত করতে চায় ।
সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (স্রেডা) ২০২০ সালে ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’ চুড়ান্ত করেছে। এই পথনকশায় উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশল অনুসরণে ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই পথনকশায় প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও নেপাল ইতিমধ্যে সম্মত চুক্তির অধীনে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত করেছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি জলবিদ্যুৎ নেপাল ও ভুটান থেকে আমদানির নানামুখী উদ্যোগ সফল করার আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আগামী ২৯-৩০ জুলাই ২০২৪ ঢাকায় বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রস্তাবিত আলোচনায়, এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে (কপ২৯) তিন প্রতিবেশী দেশ অভিন্ন অবস্থান নিতে আগ্রহী; যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এ অঞ্চলের মানুষ লাভবান হতে পারে ।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষত নেপাল, ভুটান ও ভারত নবায়নযোগ্য এবং সবুজ জ্বালানি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের পথে এগিয়েছে। প্রাকৃতিক অনুকূল উৎসের (সৌর, বায়ুশক্তির প্রাপ্যতা, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল ভৌগলিক পরিবেশ) সহজলভ্যতার কারণে সেটি সম্ভব হয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনও ৩%-৪% শতাংশে সীমিত রয়েছে। অতি ঘন বসতির কারণে জমির দুষ্প্রাপ্যতা বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রতিবন্ধক। তবু দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন অবধি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ভূমি ক্রয় ও উন্নয়নের কাজ নিজেদের করতে হয়। উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করে নবায়নযোগ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ভূমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের আরও বড় পরিসরে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
‘নেট মিটারিং পলিসি’ সুবিধা সম্প্রসারিত হওয়ায় শিল্প-কারখানার ছাদের জায়গাগুলো ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ বাড়ছে। কিন্তু সরকারি, বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনার ছাদ এখনও অব্যবহৃত রয়েছে। কেবলমাত্র ‘থ্রি-ফেজ’ বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বিষয়টি ‘নেট মিটারিং পলিসি’র আওতায় সীমিত রাখার ফলে শিল্প-কারখানার ছাদ ছাড়া অপর সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি মনে করে যে, ২০২৪ সালে পরিচ্ছন্ন (কার্বন দূষণমুক্ত উৎস যেমন নবায়নযোগ্য ও পরমাণু শক্তি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা) উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিদ্যুৎ সংরক্ষণ (স্টোরেজ) জ্বালানি দক্ষতা উন্নয়ন খাতে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বিনিয়োগ সম্ভব হবে। লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট (৬ জুন ২০২৪) অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের সাথে তুলনায় পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দি¦গুন হয়েছে; যদিও জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস ও কয়লা) খাতে চলমান বিনিয়োগের পরিমাণ এখনও বিশাল। জাতিসংঘের পূর্ববর্তী জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত রাখার যে সম্মত ঘোষণা দেওয়া হয়েছে; বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিপুল বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বিপুল চলমান বিনিয়োগ পূর্ববর্তী জলবায়ু সম্মেলনের অঙ্গীকার সমূহকে অর্থহীন ঘোষণায় পরিণত করছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, জাতিসংঘের দুবাই জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৮) বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য উৎসের ভূমিকা তিনগুন বাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। অধিকাংশ দেশকে আগামীতে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর দেশ হবার পথে বড় পথ পাড়ি দিতে হবে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের ঘোষণায় অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ তাদের জাতীয় কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সুস্পষ্ট নীতি ও তার বাস্তবায়ন কৌশল প্রণয়নের অঙ্গীকার করেছে।
প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নে ঘরে বাইরে মানুষ সহজে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারও বহুগুন বেড়েছে। গত শতাব্দী জুড়ে জ্বালানি খাতে সাতটি বহুজাতিক কোম্পানি (এক্সন মোবিল কর্পোরেশন, শেভরন কর্পোরেশন, শেল পিএলসি, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম পিএলসি, টোটাল এনার্জি এসই, কনকো ফিলিপস এবং ইএনআই এসপিএ) জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহ করে বিশ্বজুড়ে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। এ কোম্পানিগুলো প্রধানত তেল-গ্যাস-কয়লা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে একচ্ছত্র বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভাগাভাগি করে ব্যবসা করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানির জন্য এখনও সাধারণভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহকারীদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। অবশ্য চীনা মালিকানার ৭টি নতুন প্রতিষ্ঠান (টংওয়েই কোম্পানি, জিসিএল টেকনোলজি হোল্ডিংস লি., জিনতে এনার্জি কোম্পানি, লংগি গ্রিন এনার্জি টেকনোলজি কোম্পানি, তৃনা সোলার কোম্পানি, জেআ সোলার টেকনোলজি কোম্পানি এবং জিনকো সোলার কোম্পানি) জ্বালানি খাতে বর্তমানে বিশ্বের প্রভাবশালী প্রধান কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। মজার ব্যাপার হলো, সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোকশক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার যে প্রযুক্তি বা ‘ফটোভোল্টাইক সেল’ এর উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবসা থেকে প্রধান জ্বালানি কোম্পানি হিসেবে এই চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচিতি পেয়েছে। ব্লুমবার্গ রিপোর্ট বলছে (১৪ জুন ২০২৪) বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎসের নিয়ন্ত্রণ বিবেচনায় উল্লিখিত ৭টি চীনা কোম্পানির দাপট এখন গত শতাব্দীর প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহকারী দাপুটে ‘সেভেন সিস্টারস’ এর চেয়েও বেশি। সুতরাং বলা যেতেই পারে, এ শতাব্দী হলো নবায়নযাগ্য জ্বালানির।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ