নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভরতার স্বপ্ন

মুশফিকুর রহমান

বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণে জ্বালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের বাণিজ্যিক জ্বালানির ৩% শতাংশেরও কম যোগান দেয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি (জলবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, বায়োমাস জ্বালানি)। অবাণিজ্যিক জ্বালানির ব্যবহার এখনও দেশে ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় অর্ধেক। এখনও দেশে পাল তোলা নৌকা পরিবহন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কৃষি ও খাদ্যপণ্য শুকানো, প্রক্রিয়াকরণে, রান্না, কাপড়-সুতা শুকানো, শুঁটকি মাছসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রি প্রস্তুতি ও সংরক্ষণে সূর্যের আলো, তাপ এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। নির্মাণ কাজে কাদা দিয়ে তৈরি ইটের বিকল্প এখনও নগণ্য। ইট তৈরির বিদ্যমান ও ব্যাপক ব্যবহৃত প্রযুক্তিতে সূর্যের আলো-তাপ আর গাছপালার ভূমিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব। এবং তাতে জ্বালানি ব্যবহার থেকে দূষণ ছড়ানোর ব্যাপ্তি সম্পর্কে অনুমান করা সহজ।

জীবন ও জীবিকা অব্যাহত রাখতে জ্বালানি ব্যবহার ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু অনবায়নযোগ্য জ্বালানির যোগান যেভাবে দুর্লভ হয়ে উঠছে তাতে বিশ^জুড়ে বিকল্প খোঁজার তাগিদ বাড়ছে। সেই সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির (খনিজ তেল, গ্যাস, কয়লা) ব্যবহার সঙ্কুচিত করার তাড়া বৈশি^কভাবেই বেড়েছে (জীবাশ্ম জ্বালানি এবং বায়োমাস জ্বালানি পোড়ালে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়া ‘গ্রিন হাউস গ্যাস’ বৈশ্বিক আবহাওয়ামণ্ডলীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বড় ইন্ধন হিসেবে কাজ করে)। পৃথিবীর অনেক দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত সঙ্কুচিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্প-কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সঙ্কুচিত করা, বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত মোটরগাড়ির ব্যবহার বাড়ানো, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার ও তার সম্প্রসারণ, পুনচক্রায়নের অর্থনীতিকে উৎসাহ প্রদান (যাতে বর্জ্যরে পরিমাণ সঙ্কুচিত হয়, বর্জ্য উপাদানসমূহকে সম্পদে রূপান্তরিত করা যায়) অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি (বাণিজ্যিক জ্বালানি) মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর (নগণ্য পরিমাণ জলবিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ ছাড়া সেখানে অন্য উৎসের অবদান এখনও প্রায় অনুপস্থিত)। আমদানি করা বিদ্যুতের পুরোটাই এখনও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ও পুনরুচ্চারিত ঘোষণা অনুযায়ী, শিঘ্রি বিশ^জুড়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিটি দেশ কোন কৌশলে জ্বালানি সিস্টেমে ‘নেট জিরো’ অর্জন করবে তার পরিকল্পনা তৈরি করবে। এই পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে অন্তবর্তী জ্বালানি ব্যবস্থাপনা। এই পটভূমিতে, অনেকে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর, বায়ু, জিওথারমাল, সমুদ্রের পানির স্রোতনির্ভর বা টাইডাল, বায়োমাস) নির্ভর ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। বিদ্যমান প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে সূর্যের আলোকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরের প্রযুক্তি নির্ভর সৌরবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশের ভৌগলিক বাস্তবতা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, জীবিকার ধরন এবং নির্ভরতা, অব্যবহৃত জমির লভ্যতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের যোগান, আর্থিক ও কারিগরি সামর্থের নিরিখে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর দেশ হওয়া কতটা বাস্তব?

প্রথমত বাংলাদেশ একটি অতিঘন বসতির দেশ এবং এদেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অব্যবহৃত জমির পরিমাণ নগণ্য। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির লভ্যতা বিবেচনায় বাণিজ্যিক জ্বালানির উৎস এদেশে সীমিত। ভূপ্রকৃতির বাস্তবতায় এখনও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ নগণ্য। বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন সুযোগ কতটুকু সম্প্রসারণ করা যায় সেটি সম্পর্কে স্পষ্টতা কম। কার্যত কেবল সৌরবিদ্যুৎ নির্ভর উৎস বিবেচনায় শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ পরিকল্পনা অকার্যকর। বাধাহীন উজ্জ্বল আকাশ আলো দিলে সৌরবিদ্যুৎ এখনও দিনের বেলায় পাওয়া শক্তির উৎস। দিনের বেলা সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করে রাতে ব্যবহারের জন্য যে ব্যাটারি দরকার তা ব্যয়বহুল এবং সরবরাহ সীমিত। তাছাড়া ব্যাটারির জন্য ব্যয় বিবেচনায় নিলে সৌরশক্তির তুলনামূলক ব্যয় এখনও নাগালের বাইরে দুর্মূল্যের পণ্য। অতিঘন বসতির প্রায় সমতল ভূমির বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত খালি জায়গা পাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয় (এক মেগাওয়াট পরিমাণ সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন প্রায় ৪ একর পরিমাণ উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন হয়)। প্রায় দশ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দেশের মোট ফসলি কৃষি জমির প্রায় ২% ব্যবহারের পক্ষে জনমত কতটা থাকবে বলা মুশকিল। তাছাড়া দেশের খাদ্যনিরাপত্তার অগ্রাধিকার বিবেচনায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি উৎসর্গ করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য সে জরিপও কেউ করেনি (ভিন্ন মতের মানুষ অবশ্য বলেন যে, পরিবেশবান্ধব নবায়ন যোগ্য সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে কৃষি জমির কয়েক লক্ষ একর কাজে লাগানো গেলে, চুড়ান্ত বিচারে তা কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে এবং মানুষেরই কাজে লাগবে)।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকার শিল্প নির্ভর দেশগুলোতে দেশগুলোর ভৌগলিক অবস্থা, পরস্পর সংযুক্ত বৈদ্যুতিক গ্রিড, বৈচিত্রময় নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস, কারিগরি ও আর্থিক সামর্থের অনুকূল অবস্থা কাজে লেগেছে। ব্রিকসভুক্ত (সম্প্রসারিত) দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদানে দ্রুত সামনে এগুচ্ছে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর বিদ্যমান সম্পদ, বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত বিরানভূমি, প্রযুক্তির সুবিধা বিচারে অসলো ভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান ‘রিস্টার্ড এনার্জি’ আশা প্রকাশ করেছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে তারা প্রায় ৮০% শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহ করবে। ইতিমধ্যে ব্রিকসভুক্ত দেশসমূহে বৈদ্যুতিক মোটরগাড়ি উৎপাদনে শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ ও বিক্রিতে জি৭ জোটকে ছাড়িয়ে গেছে ব্রিকস জোটের চীন। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে সহযোগিতা আগামীতে আরও বাড়বে ।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানোর সাথে উৎপাদিত বিদ্যুতের যৌক্তিক ও কার্যকর ব্যবহার বাড়াতে বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চয় (ব্যাটারিতে সঞ্চয়) করবার আর্থিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সামর্থ এবং বড় বিনিয়োগ সম্পর্কিত। ব্যাটারি এখনও ব্যয়বহুল। ফলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হলে, আমরা কত বিনিয়োগ করতে পারব বা বড় বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করতে পারব তার উপর ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করবে। সে বিবেচনায়, বেশি বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে ব্যবহারকারী কত ব্যয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত সে প্রশ্নও জড়িত।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − three =