নাইজারে যুদ্ধের দামামা

মাহবুব আলম

সম্প্রতি দেশে ও বিদেশে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। এগুলো হচ্ছে; ভারতের চন্দ্র বিজয়, ব্রিকসের সম্প্রসারণ, রাশিয়ায় বিমান দুর্ঘটনায় ভাড়াটে সৈন্যদের বৃহত্তর সংস্থা ওয়াগানার গ্রুপের কমান্ডার প্রিগোজিনের মৃত্যু, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানা পড়েন, এই নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের নানামুখী তৎপরতা, দেশের ভেতর প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলের লাগাতার সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, সেইসঙ্গে নিত্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং আফ্রিকার দেশ নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান পরবর্তী ব্যাপক উত্তেজনা ইত্যাদি।

এই ঘটনাগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে ভারতের চন্দ্র জয় খুব বড় ঘটনা। এটা খুব বড় ঘটনা হলেও প্রথম ঘটনা নয়। ইতিপূর্বে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন চন্দ্র জয় করেছে। সেই হিসেবে ভারতের চন্দ্র জয় হল চতুর্থ ঘটনা। তাই এই বিষয়টি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত কয়েক সপ্তাহ নাইজারের ঘটনা, উত্তপ্ত-উত্তেজনা সব ঘটনাকে ছড়িয়ে গেছে। তাই সমসাময়িক ঘটনায় নাইজারই অগ্রাধিকারের দাবি রাখে।

কার্যত নাইজারে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। যে কোনদিন এ দেশটি আক্রান্ত হতে পারে। আর আক্রান্ত হওয়া মানে যুদ্ধ শুরু। যে যুদ্ধে এক পক্ষে আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত হতদরিদ্র দেশ নাইজার, অপর পক্ষে বিশ্বের শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশবাদী দেশ ফ্রান্স ও তার সহযোগী আফ্রিকার প্রায় এক ডজন দেশ। এমনকি এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও জড়িয়ে পড়তে পারে। জড়িয়ে পড়তে পারে মুসলিম বিশ্বের শক্তিধর দেশ তুরস্কও। আর যদি তাই হয় তাহলে এই যুদ্ধ হবে এক ভয়ঙ্কর মানববিধ্বংসী যুদ্ধ। এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ।

এখন প্রশ্ন হলো কেন এই যুদ্ধ? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে; নাইজার তথা আফ্রিকায় ফ্রান্সের আধিপত্য ধরে রাখার যুদ্ধ। অন্যদিকে ফ্রান্সের নব্য ঔপনিবেশিক শোষণ নির্যাতন থেকে নাইজার তথা আফ্রিকাকে মুক্ত করার যুদ্ধ।

গত ২৫ জুলাই ২০২৩ সালে নাইজারে এক সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ বানোম ক্ষমতাচ্যুত হন। এই অভ্যুত্থান করে প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্ট। অভ্যুত্থানের পর গার্ড রেজিমেন্টের প্রধান জেনারেল আব্দুর রহমান চিয়ানি নিজেকে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা দেন। সেইসঙ্গে তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পাদিত একটি সাময়িক চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করেন। সেই সাথে জানান, ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট বাজোমকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তার বিচার করা হবে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে।

জেনারেল আব্দুর রহমান চিয়ানির এই ঘোষণার পর রাজধানী নিয়ামেসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা অভ্যুত্থানের পক্ষে রাজপথে মিছিল সমাবেশ করে। সেই সাথে ফ্রান্সের দূতাবাসের সম্মুখে বিক্ষোভ করে স্লোগান দেয়, ফ্রান্স নিপাত যাক। বিক্ষোভকারীরা ফ্রান্সের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে একটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল অনেকের হাতে রুশ পতাকা। সেই সাথে স্লোগান, পুতিন দীর্ঘজীবী হোক। এমনই একটি সমাবেশ হয় রাজধানীর একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে। এই সমাবেশে অভ্যুত্থানের জড়িত সেনা কর্মকর্তারা পর্যন্ত বক্তৃতা করেন। ওই সমাবেশও অনেকের হাতে রুশ পতাকা দেখা গেছে। অবশ্য, এ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই কোনরকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে, সেনা অভ্যুত্থানের পর পরই ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সমগ্র-পশ্চিমা দুনিয়ায় অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট বাজোমকে মুক্তি দিয়ে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। সেইসঙ্গে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। বৈঠকে বসে পূর্ব আফ্রিকার অর্থনৈতিক জোট ইকোওয়াসের নেতৃবৃন্দ। ১৫টি আফ্রিকান দেশ নিয়ে গঠিত এই জোটের ১২টি দেশ বৈঠক থেকে প্রেসিডেন্ট বাজোমকে ৭ দিনের মধ্যে মুক্তি দিয়ে তার হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। একই সঙ্গে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে বলা হয় প্রেসিডেন্ট বাজোমকে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিলে নাইজারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এই বৈঠকের পরবর্তী আর এক বৈঠকে বলা হয়, সামরিক অভিযানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। কবে কোথায় থেকে এই সামরিক অভিযান শুরু হবে তা-ও ঠিক করা হয়েছে। ফ্রান্স সঙ্গে সঙ্গে ইকোওয়াসের এই সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দিয়ে সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতার অঙ্গীকার করে। ওই ঘটনার পর ফ্রান্স লিবিয়া থেকে আর এক হাজার সৈন্যকে নাইজার সীমান্তের কাছে প্রেরণ করে। এছাড়া নাইজারের ভিতর ফ্রান্সের একটি সামরিক ঘাঁটি তো রয়েছেই। ওইসব ঘাঁটিতে দুই থেকে তিন হাজার ফরাসি সৈন্য আছে। আছে হাজার খানেক মার্কিন সৈন্যও।

পাল্টা ব্যবস্থা অর্থাৎ যুদ্ধ প্রস্তুতি হিসেবে নাইজারের ক্ষমতাসীন অন্তবর্তী সরকার সকল সীমান্ত ও আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেনাবাহিনীতে নতুন করে সেনা নিয়োগ ও ট্রেনিং শুরু করেছে। শুধু তাই নয় ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী ওয়াগানা গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে সহযোগিতা প্রার্থনা করেছে। সহযোগিতা প্রার্থনা করেছে প্রতিবেশী দেশ বুরকিনা ফাসো, মালি ও গিনির। এর মধ্যে বুরকিনা ফাসো ও মালি রীতিমতো যুদ্ধের অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে নাইজারে সৈন্য প্রেরণ শুরু করেছে। সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ এমনকি যুদ্ধ বিমান। কারণ নাইজারের বিমান বাহিনীতে অ্যাটাক হেলিকপ্টার থাকলেও ফাইটার জেট নেই। বুরকিনা ফাসো নাইজারকে ফাইটার জেট দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

নাইজার এর মধ্যে ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তার দেশ থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে টানটান উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই উত্তেজনার মধ্যেই চলছে উভয়পক্ষের যুদ্ধ প্রস্তুতি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও রাশিয়া শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জোর প্রচেষ্টা নিয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া ও তুরস্ক জোর দিয়ে বলেছে, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয় বরং যুদ্ধ ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। তা হবে খুবই বিপদজনক।

উল্লেখ্য, নাইজার দীর্ঘদিন ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল দীর্ঘ আন্দোলনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৬০ সালের ৩ আগস্ট দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ বছর পরও বিপুল খনিজ সম্পদে ভরপুর এ দেশটি এখনো হতদরিদ্র। এর কারণ উপনিবেশিক সংবিধানিক চুক্তি। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার দেওয়ার সময় ফ্রান্স ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো নাইজারকেও ওই চুক্তিতে আবদ্ধ করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী নাইজার নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে না। ব্যবহার করতে হয় ফ্রান্সের মুদ্রা, যার মূল্যমান নির্ধারণ করে প্যারিসের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির রিজার্ভ রাখতে হয় প্যারিসের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এখানেই শেষ নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন করতে হয় যে কোন ফরাসি ব্যাংকের মাধ্যমে এবং বাণিজ্যের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ জমা রেখে এককালীন সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ তুলতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ নাইজারের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ফ্রান্সের ব্যাংক ব্যবসা করছে।

উপনিবেশিক সংবিধানের চুক্তির শর্তের মধ্যে রয়েছে, কোনো খনিজসম্পদ পাওয়া গেলে ফ্রান্সের অগ্রাধিকার সর্বাগ্রে। সরকারি টেন্ডারে অগ্রাধিকার ফরাসি ব্যবসায়ীদের, সেনা ট্রেনিং ও অস্ত্র ক্রয় ফ্রান্স থেকে করতে হবে। ফ্রান্সের অনুমতি ছাড়া কোনো জোটে যেতে পারবে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই মূল্যবান ইউরেনিয়াম ও স্বর্ণখনি থাকা সত্ত্বেও নাইজার হতদরিদ্র, দেশটির সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৭ শতাংশ। জিডিপি মাত্র ১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে নাইজারের ৭৫% মানুষ ফ্রান্স বিরোধী। তার প্রমাণ সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান। মানুষ অভ্যুত্থানের পরপরই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে অভ্যুত্থানের সমর্থনে। সেই সাথে যুবকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যাওয়ার প্রবণতা।

এ থেকে স্পষ্ট যে, নাইজারের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই করতে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। তাই এই যুদ্ধকে শুধু নাইজার নয়, আফ্রিকার মুক্তির লড়াই বলাই ভালো। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধের পরিণতি কি হবে তা বলা খুবই কঠিন। কারণ যুদ্ধ বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর মানুষের সঙ্গে হতদরিদ্র মানুষের যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধ সহসা শেষও হবে না। হয়তো এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেবে। হয়তো আর এক আফগানিস্তান, সিরিয়া বা ভিয়েতনামের রূপ নেবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four + 10 =